×

মুক্তচিন্তা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ পিএম

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?

সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

   

অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, মালিকদের অতি মুনাফার লোভ, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশের পরিবহন খাত। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে যানজট নিরসনে বিভিন্ন সময় নানান পদক্ষেপ নেয়া হেলেও বাস্তবে এর কোনো কার্যকর প্রভাব পড়েনি। যার ফলে রাস্তায়ই নষ্ট হচ্ছে হাজার কোটি টাকার জ্বালানিসহ মূল্যবান কর্মঘণ্টা। তাই এখনই সময় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। যার আর্থিক মূল্য ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি পুরছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। যে জ্বালানি দিয়ে শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন করে অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব।

রাজধানীর তীব্র যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্রাইভেট কার। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশই এসব প্রাইভেট কার। এক রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেট কার। এসব প্রাইভেট কার বহন করে মাত্র ১২ শতাংশ যাত্রী। কিন্তু বাকি ৪৫.৮ শতাংশ গাড়ি বহন করে ৮৮ শতাংশ যাত্রী। এর অর্থ শুধু প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ৮৮ শতাংশ যাত্রী সুফল পাবে। 

এছাড়া একটি মেগাসিটিতে তার আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। এ রাস্তার অনেক জায়গা আবার বিভিন্ন অবৈধ দখলদারের হাতে। রাস্তায় ফুটপাত, ময়লার ভ্যান, যত্রতত্র গাড়ি রেখে রাস্তাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে। ট্রাফিক আইন অমান্য করার ফলেও রাস্তার স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া চালকের অদক্ষতা, শহরমুখী মানুষের স্রোত, অপ্রশস্ত রাস্তাও যানজটের অন্যতম কারণ।  

বুয়েটের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। যেখানে বর্তমানে মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তার মানে ঢাকার রাস্তা এখন মানুষের হাটার গতি থেকেও কম। 

সড়কে একদিকে ধীর গতির রিকশা-ভ্যান ও অন্যদিকে দ্রুতগতির গাড়ি ও বাস-ট্রাকের যাতায়াতের ফলে গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এর জন্যও বাড়ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনা।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতাও একসময় যানজটের শহর ছিল, যা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তবে আজকের কলকাতা গতিময় এক শহর। শহরটিতে কোনো ট্রাফিক সিগন্যালে বড়জোর দুই থেকে তিন মিনিট সময় লাগে। কলকাতার এ উত্তরণ কী করে সম্ভব হল? এর অন্যতম কারণ কলকাতা নগরীর গাড়ি চালকদের শৃঙ্খলাবোধ ও পেশাদারী মনোভাব। কলকাতার গাড়ি চালকরা কিছুতেই ট্রাফিক সিগন্যাল বা ট্রাফিক আইনকে অবজ্ঞা করেন না। এছাড়া যাত্রী তোলার জন্য বাসগুলো কোনো প্রতিযোগিতা বা তাড়াহুড়ো করে না। যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনাও অনেক কম হয়। আর আমাদের চালকরা ঠিক এর উল্টো। কার আগে, কে যাবে এটা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এছাড়া রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে চলে যাত্রী উঠা-নামা। যেটা খোদ ট্রাফিক পুলিশের সামনেই চলে।

ঢাকার বাসগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে সর্বপ্রথম ২০০৪ সালে ঢাকার জন্য করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর এক যুগ পরে ২০১৬ সালে এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। ঢাকার শতাধিক বাস রুট বাদ দিয়ে কেবল ৫টি রুটে ভাগ করে ৫ রঙের বাস চালানোর পরিকল্পনা হাতে নেন তিনি। কিন্তু ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগে ভাটা পড়ে। এরপর আবারো গত সরকারের আমলে এ  উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস মালিকদের অসহযোগিতায় সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই উদ্যোগ আবারো চালু করতে পারে। বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের অধীনে ঢাকাকে মোট ৪২টি পথে ভাগ করে এক কোম্পানির অধীনে বাস চালানোর এ পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামবে ও যাত্রী ওঠানামা করবে, পরিবহন শ্রমিকদের জন্য থাকবে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা এবং মাসিক বেতন। ফলে সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে আসবে।

চাঁদাবাজিকে সড়কে বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করে বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গণপরিবহনের চাঁদাবাজির বিপুল অর্থ সরকারি অনেক কর্মকর্তা পর্যন্ত পৌঁছায়। তাই গণপরিবহনের উন্নতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। রাজনৈতিক পোশাকের একটি গোষ্ঠী গণপরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে। এই সিন্ডিকেট আমাদের ভেঙ্গে দিতে হবে। 

যানজট সমস্যার সমাধানে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে পারে

যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি। রাজধানীকে সবার জন্য বসবাস উপযোগী করতে সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি। বিশ্বের যেসব শহরে আগে যানজট ছিল কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রিত, সেসব শহরের সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের আমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে যানজট নিরসনে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। 

একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দিতে ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেবে। 

শহরের প্রাইভেট কারের অবাধ চলাচল বন্ধ করা, অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে ফুটপাথ ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। মূল সড়কে রিকশা-ভ্যান চলাচল বন্ধ করা, গাড়িচালককে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং যত্রতত্র গাড়ি রাখা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা গেলে যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৩০-২৫০ মিলিয়নে পৌঁছাবে এবং এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় অংশ ঘটবে শহরাঞ্চলে। এখনই যানজট হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আমাদের প্রত্যাশা গণপরিবহনে (বাস, রেল ও নৌপথ) বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে একটি বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত ও জনবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সব পক্ষকেই কাজ করতে হবে।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App