স্টাইলিশ হিরো জাফর ইকবাল
অমর হয়ে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
চোখে সানগøাস, স্টাইল করা চুল, হাফ হাতা গেঞ্জি গায়ে ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন, রুচিবোধ আর আধুনিকতায় তিনি ছিলেন ক্রেজ। স্টাইলিশ আর অনবদ্য অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেই গান গাইতেন, বাজাতেন গিটার-হারমোনিয়াম, বন্ধুদের নিয়ে ব্যান্ডও গড়েছিলেন। ৭০-৮০-এর দশকের কিংবদন্তি চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের পরিচয় এমনই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও এ নায়ক সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল এই নায়ক, গায়ক, গিটারিস্ট ও মুক্তিযোদ্ধার জন্মদিন। ১৯৫০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাফর ইকবাল। তার বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ এবং ছোট বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহ দুজনেই সংগীতশিল্পী। জাফর ইকবালের মতো তারা দুজনও বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের আগেই চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন জাফর ইকবাল। তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘আপন পর’। এতে জাফর ইকবালের বিপরীতে অভিনয় করেন প্রয়াত কবরী সারোয়ার। পরবর্তীতে নায়িকা ববিতার সঙ্গে তার জুটি দর্শক নন্দিত হয়ে ওঠে। ৩০টির মতো ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন জাফর ইকবাল ও ববিতা। এ জুটির বাস্তব জীবনের রসায়নও বেশ জমে উঠেছিল বলে গুঞ্জন আছে। ২০২১ সালে চিত্রনায়িকা ববিতা তার জন্মদিনে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, জাফর ইকবাল এবং তিনি একে-অপরকে পছন্দ করতেন। তবে বেশিদূর গড়ায়নি সে সম্পর্ক। ১৯৮৯ সালে জাফর ইকবাল অভিনীত ত্রিভুজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ হৃদয়’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। সে ছবিতে আপন দুই বোন চম্পা ও ববিতার বিপরীতে জাফর ইকবালের অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারে প্রায় ১৫০টি ছবি করেন প্রয়াত এ নায়ক। যার বেশির ভাগই ব্যবসাসফল।
৭০ দশকের মাঝামাঝি ‘সূর্য সংগ্রাম’ ছবিতে ববিতার বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মাস্তান’ ছবির বদৌলতে ‘ড্যাশিং’ নায়কের পরিচিতি পান জাফর ইকবাল। তিনি রোমান্টিক নায়ক হিসেবে পরিচিতি পান ‘নয়নের আলো’ সিনেমার মাধ্যমে। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো- ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘ভাই বন্ধু’, ‘অবদান’, ‘প্রেমিক’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘দিনের পর দিন’, ‘বেদ্বীন’, ‘অংশীদার’, ‘মেঘ বিজলী বাদল’, ‘নয়নের আলো’, ‘সাত রাজার ধন’, ‘আশীর্বাদ’, ‘অপমান’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘গৃহল²ী’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘প্রেমিক’, ‘নবাব’, ‘প্রতিরোধ’, ‘ফুলের মালা’, ‘সিআইডি’, ‘মর্যাদা’, ‘সন্ধি’, ‘বন্ধু আমার’, ‘উসিলা’ ইত্যাদি।
শহুরে রোমান্টিক ও রাগী তরুণের ভূমিকায় দারুণ মানাত জাফর ইকবালকে। তবে সব ধরনের চরিত্রেই তার স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ ছিল। ১৯৭৫ সালে ‘মাস্তান’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় জাফর ইকবালকে ওই প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাগী, রোমান্টিক, জীবন যন্ত্রণায় পীড়িত কিংবা হতাশা থেকে বিপথগামী তরুণের চরিত্রে তিনি ছিলেন পরিচালক ও প্রযোজকদের প্রথম পছন্দ। অভিনয়ের পাশাপাশি চমৎকার গানও গাইতেন জাফর ইকবাল। ফলে বেশ কিছু ছবিতে তিনি গায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ সালে একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন জাফর ইকবাল। তার প্রথম সিনেমায় গাওয়া গান ছিল ‘পিচ ঢালা পথ’। ১৯৮৪ সালে জাফর ইকবালের কণ্ঠে বড় ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গানটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
মূলত জাফর ইকবাল ছিলেন নামকরা গিটারিস্ট। ভালো গিটার বাজাতেন বলে প্রখ্যাত সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে অনেক ছবির আবহসংগীতও তৈরি করিয়েছিলেন। তার গানের প্রশংসা করে আরেক কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা ববিতা বলেছিলেন, ‘জাফর ইকবাল খুব ভালো ইংরেজি গান গাইতে পারতেন। গিটার বাজিয়ে তার কণ্ঠে ইংলিশ গান শোনাটা আমাদের সময়কার যে কোনো মেয়ের জন্য স্বপ্নের একটি মুহূর্ত।’
সিনেমায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় গানে সেভাবে কাজ করতে পারেননি জাফর ইকবাল। তবে প্রকাশ করেছিলেন ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শীর্ষক একটি একক অ্যালবাম। তার গাওয়া প্রায় ২০০ গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’, ‘এক হৃদয়হীনার কাছে’, ‘যেভাবেই বাঁচি বেঁচে তো আছি’, ‘শেষ করো না শুরুতেই খেলা’ গানগুলো কালজয়ী হয়ে আছে।
যদিও এত গুণে সমৃদ্ধ এই নায়কের শেষ জীবনটা ছিল বড়ই করুণ। পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের বাবা ছিলেন জাফর ইকবাল। তার স্ত্রীর নাম ছিল সনিয়া। অভিনয় এবং সংগীত দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে আলো ছড়ালেও সেই আলোর রেশ ছিল না অভিনেতার পরিবারে। পারিবারিক অশান্তির কারণে এক সময় খুব ভেঙে পড়েন জাফর ইকবাল। মদ হয়ে গিয়েছিল তার নিত্যসঙ্গী। মদের তীব্র নেশা আর নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের কারণেই একসময় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন জাফর ইকবাল। দেখা দেয় হার্টের সমস্যা। নষ্ট হয়ে যায় তার দুটি কিডনিই। নানা জটিল রোগে জর্জরিত নায়ক ১৯৯২ সালের ২৭ এপ্রিল মাত্র ৪১ বছর বয়সে চলে যান অনন্তলোকে।
কিন্তু কণ্ঠে ও অভিনয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন দেশীয় শোবিজের ইতিহাসে। তার ঠোঁট মেলানো ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর’, ‘তুমি আমার জীবন’ কিংবা ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’ গানগুলোতে অমর হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।