×

মেলা

সত্যজিতের সিনেমায় ব্রিটিশ শাসন

Icon

মেলা প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সত্যজিতের সিনেমায় ব্রিটিশ শাসন

সত্যজিত রায়

   

ঘরে বাইরে (১৯৮৪)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে প্রথম চলিত ভাষায় কোনো বই লেখেন। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটির নাম ‘ঘরে বাইরে’। উপন্যাসের প্রধান তিন চরিত্র বিমলা, নিখিলেশ চৌধুরী ও সন্দীপ মুখুজ্যে। উপন্যাসটির নামের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে সত্যজিৎ রায় ১৯৮৪ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘ঘরে বাইরে’। যেটির চিত্রনাট্য তিনি লিখে রেখেছিলেন তার প্রথম ছবি পথের পাঁচালী নির্মাণেরও আগে। কিন্তু নির্মাণ কিংবা মুক্তির দিক দিয়ে এটি সত্যজিতের ক্যারিয়ারের শেষ দিককার ছবি। এই ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, জেনিফার কাপুর ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ছবিতে নারীমুক্তির বিষয়কে অন্য আঙ্গিকে দেখানো হয়েছে, সঙ্গে দেখানো হয়েছে স্বদেশী আন্দোলনের নেতিবাচক কিছু দিক। প্রধান তিন চরিত্র বিমলা, সন্দীপ মুখুজ্যে আর নিখিলেশ চৌধুরী যেন কেবলমাত্র তিনটা চরিত্রই নয়, সময়ের বাংলার তিন ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের চিন্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য দিয়ে যেন সেই সময়ের বাংলাই প্রকাশ পেয়েছে।

ঘরের প্রতীক বিমলা (স্বাতীলেখা) ও বাইরের প্রতীক সন্দীপকে (সৌমিত্র) কেন্দ্র করেই ছবির গল্প এগিয়েছে। উদার ও আধুনিকমনস্ক জমিদার নিখিলেশের (ভিক্টর) শখ তার স্ত্রীকে আধুনিক নারী রূপে গড়ে তোলার। তাকে ইংরেজি শেখানো, পশ্চিমা সংগীত-সাহিত্য চর্চা করানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে নিখিলেশ তার বউকে নিজের মনমতো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। নিয়মের শেকল ভেঙে তাকে অন্দরমহল থেকে বাইরে নিয়ে আসে। স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সন্দীপ জমিদার নিখিলেশের আতিথ্য নিয়ে তার বাড়িতে থেকে সেই গ্রামে চালাতে থাকে স্বদেশি কর্মকাণ্ড। গল্পে স্বদেশি আন্দোলনের নেতা সন্দীপকে কখনো নায়ক হিসেবে দেখানো হয়নি। যে সারাদিন স্বদেশী আন্দোলনের বুলি আওড়ায়, বিদেশি জিনিস বর্জন করার ঘোষণা দেয়, দিনশেষে তারই আবার বিলিতি সিগারেট ছাড়া মুখে কিছু রোচেনা। বিমলা অন্দরমহলের চৌকাঠ পেরিয়েই সন্দীপের মেকি প্রতিভার মোহে পড়ে যায়, শুরু হয় তাদের গোপন অভিসার। শেষদিকে আবার সেই ভুল বুঝতে পেরে বিমলা ফেরে নিখিলেশের কাছে। উদার মনের মানুষ নিখিলেশ এই মানব-মনের ভুলকে সহজেই মেনে নেয়। শেষদিকে স্বদেশিদের কারণে উদ্ভূত দাঙ্গায় বিধবা হয় বিমলা।

ছবিটির একটা জিনিস ভীষণভাবে প্রকট, আর তা হলো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্যবহৃত ‘বন্দে মাতরম’ সেøাগানটি ভারতবর্ষের সব ধর্মের মানুষ আপন করে নেয়নি, যা স্বয়ং রবিঠাকুরও মেনেছেন। এছাড়া নিম্নবিত্ত, গরিব কৃষক, মজুরদের এই আন্দোলনের মূলধারায় কখনো আনা যায়নি। ইতিহাস বলে স্বদেশি আন্দোলন ভারতবর্ষের কিংবা বাঙালির জন্য না, এটা কলকাতাবাসীর কোনো এক গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্বার্থেই ব্যবহার হয়েছিল। এসব তিক্ত দিকই দেখনো হয়েছে পুরো ছবিতে। ছবিটি নির্মাণকালে দুটি বড় রকমের হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিৎ রায়ের। তার পুত্র সন্দীপ রায় সত্যজিতের পরামর্শ নিয়ে ছবির বাকি থাকা কাজগুলো শেষ করেন। ছবিটিতে বাড়তি আকর্ষণ ছিল সত্যজিতের চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো চুম্বনদৃশ্য। উল্লেখ্য, বিমলা চরিত্রের জন্য সত্যজিৎ ভেবেছিলেন সুচিত্রা সেনকে। তবে সুচিত্রা রাজি না হওয়ায় মঞ্চ অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে বিমলা চরিত্রের জন্য বেছে নেয়া হয়। ছবিটি ১৯৮৪ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি’অর-এর জন্য প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে দেখানো হয়।

শতরঞ্জ কি খিলাড়ি (১৯৭৭)

সত্যজিৎ রায় মুন্সী প্রেমচাঁদের ছোট গল্পকে বেছে নেন এই ছবির জন্য। ছবিটি নির্মাণ করেন উর্দু ভাষায়, যেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম কোনো উর্দু ছবি। ১৮৫৬ সালের ব্রিটিশ রাজের সময়কার কাহিনিতে দুটি গল্প সমান্তরালভাবে দেখিয়েছেন পরিচালক। হালকা মেজাজের প্রথম গল্পে তৎকালীন দুজন বিত্তবানকে দেখা যায় তাদের সংসারধর্ম ছেড়ে মজে আছেন দাবা খেলায়। অন্যদিকে ভারি মেজাজের গল্পে দেখানো হয় ব্রিটিশদের আওয়াধ রাজ্য দখল করে শাসক ওয়াজিদ আলী শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার গল্প। ছবিটি ধারা বর্ণনায় ছিলেন বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন। ছবির মূল চরিত্রে দেখা গেছে আমজাদ খান, সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, শাবানা আজমি, রিচার্ড স্যামুয়েল অ্যাটনবারা ও ফরিদা জালালকে। ছবিটি সত্যজিতের ক্যারিয়ারের অন্যতম ব্যয়বহুল ছবিও বটে। শতরঞ্জ কি খিলাড়ি ভারত থেকে অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করে।

নবাবদের শহর লখনৌর তৎকালীন রাজ্য আওয়াধের রাজাদের শৌখিনতার কোনো কমতি ছিল না। শোনা যায়, আওয়াধ রাজ্যের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের খাবার আলাদা ছয়টি রন্ধনশালা থেকে আনা হতো। ‘দমপোখ্ত’ কিংবা ঢিমে আঁচে রান্না ওয়াজিদ আলীই প্রথম নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি রন্ধনশৈলীতে। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তার হাতেই কিনা, তা নিয়ে কিছুটা অবশ্য বিতর্ক আছে। এই ওয়াজিদ আলী শাহ ছিলেন একজন শিল্পকলার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক, একাধারে কবি ও নৃত্যশিল্পী অনুরাগী, যিনি ভারতীয় ক্লাসিকাল নৃত্য কত্থকে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। কেউ কেউতো তাকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেন। সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক এক বছর আগে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশরা আওয়াধ রাজ্যের পতন ঘটায়। লেখক মুন্সী প্রেমচাঁদ সেখান থেকে লেখেন উর্দু গল্প ‘শতরঞ্জ কি বাজি’, যার অনুসারে ১৯৭৭ সালে সত্যজিৎ রায় ছবিটি নির্মাণ করেন।

ছবির একদিকে দেখা যায় এই নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর ইংরেজদের পরিকল্পনা ও এতে এ ব্যাপারে নবাবের প্রতিক্রিয়া। অন্যদিকে দুজন ধনী মীর্জা সাজ্জাদ আলী এবং মীর রওশন আলীর গল্প দেখানো হয়েছে, যাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞানই হচ্ছে দাবা (শতরঞ্জ) খেলা। সেই দাবা খেলার মোহে নিজ বাসা, পরিবার ছেড়ে তারা পাড়ি জমায় অচিন এক গ্রামে। শোলে ছবিতে গাব্বার সিং করে খল চরিত্রে খ্যাত হওয়া আমজাদ খানকে এই ছবিতে পজিটিভ চরিত্রে এনেছিলেন সত্যজিৎ, যা সমালোচকরা খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিল। ছবিতে দেখানো ঘুড়ি ওড়ানো, মোরগ কিংবা মেষের লড়াই যেন সেই সময়টাকেই পর্দায় ফুটিয়ে তোলে।

ছবির পেছনের এক মজার গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক, শাবানা আজমিকে যখন জানানো হয়েছিল শতরঞ্জ কি খিলাড়িতে তিনি দুই কি তিন দৃশ্যে অভিনয় করবেন, শাবানা নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, যদি আমাকে সত্যজিৎ রায় তার ছবিতে শুধু ঝাড়ু হাতে নিয়ে একটি শট দিতে বলে আমি তাও খুশি খুশি মনে করে দেব! এই না হলে সত্যজিৎ রায়!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App