মেধাশূন্য চলচ্চিত্র শিল্প

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
ষাটের দশকে উর্দু ছবির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত এফডিসির চলচ্চিত্র নির্মাতা-শিল্পী-কুশলীরা। এই প্রতিবাদের ভাষায় ছিল না রাজপথের সংযোগ। ছিল না কোনো জ্বালাও-পোড়াও, মিটিং-মিছিল। শিল্পীরা নিজেদের মেলে ধরেছিলেন ক্যামেরার সামনে। নির্মাতারা এই অঞ্চলের মাটি ও মানুষের গল্পকে তুলে ধরেছিলেন সেলুলয়েডে। প্রাণের চলচ্চিত্রকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রাণান্তকর চেষ্টার ফলে শিল্প হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠা পায়। স্বাধীনতার পর প্রভূত বাণিজ্যিক সাফল্যে শক্ত ভিত্তির ওপর সটান দাঁড়িয়ে যায় এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্প।
প্রাথমিক অবস্থায় বাংলা চলচ্চিত্রকে যারা তাদের শ্রমে, ঘামে, মেধায়, মননে সুজলা-সুফলা করেছেন তারা একে একে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিচ্ছেন। বিদায় নিচ্ছেন প্রিয় প্রাঙ্গণ এফডিসি থেকেও। প্রকৃতির নিয়মেই যেতে হচ্ছে তাদের। মেনে নিতে কষ্ট হলেও চলচ্চিত্রের গুণী ব্যক্তিত্বরা একে একে চলেই যাচ্ছেন। যাদের ত্যাগে, নিষ্ঠায়, কর্মে এই চলচ্চিত্র শিল্প এগিয়ে গেছে চূড়ার দিকে, শীর্ষের দিকে, শ্রেষ্ঠত্বের দিকে, তারা ধীরে ধীরে অস্তাচলে হারিয়ে যাচ্ছেন। ষাটের দশকে যারা গড়েছেন এই শিল্পকে, যারা আশির দশকে উন্নতির জোয়ারে প্লাবিত করেছেন, এমনকি যারা নব্বই দশকে এসেও হাত মিলিয়েছেন সফরে, তারাও নিভে যাচ্ছেন। যারা সৃজনশীল নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, যারা প্রেক্ষাগৃহ কাঁপিয়েছেন, যারা সম্মান এনেছেন বহির্বিশ্ব থেকে, এই গুণী মানুষগুলো তাদের দুনিয়াদারি খতম করে পাড়ি দিচ্ছেন অজানার পথে। যদিও রেখে গেছেন তাদের সৃষ্টিকর্ম, তাদের হারিয়ে তবু দিশাহারা চলচ্চিত্রাঙ্গন।
সাহিত্যভূমিতে সোনা ফলিয়ে চলচ্চিত্রের উঠানে এসেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হলবিমুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা তার বইয়ের পাঠক, টেলিভিশনে নাটকের দর্শক, তাদের সিনেমা হলমুখী করেছিলেন এই গল্পের জাদুকর। ‘আগুনের পরশমণি থেকে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’- তার চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি থেকে মানবিক আবেদন। তার কল্যাণে রুচিশীল দর্শকদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল সিনেমা হলে। এই খ্যাতনামা মানুষটির মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গনের ক্ষতি হলো অপূরণীয়, চলচ্চিত্র শিল্পও আরো সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ হারাল।
দেশে যতটা না কদর পেয়েছিলেন, তার চেয়ে বিদেশে তার সম্মান ছিল বেশি। তারেক মাসুদ ছিলেন বাইরের দুনিয়ায় বাংলাদেশের নিশানবাহী। ‘মুক্তির গান’ থেকে ‘মাটির ময়না’- তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রকর্ম রতœভাণ্ডারের মতোই আগলে রাখবে ভবিষ্যতের চলচ্চিত্রকর্মীরা। কিন্তু আগলে রাখা গেল না সৃষ্টিকর্তাকেই। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা তার সঙ্গে কেড়ে নিল গুণী চিত্রগ্রাহক মিশুক মনিরকেও।
হারানোর মিছিলে এরপর শামিল হলেন চাষী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র- সর্বত্রই তিনি অগ্রগামী। নেতৃত্ব দিয়েছেন চলচ্চিত্র শিল্পের। তার চলে যাওয়ায় অভিভাবক হারানোর বেদনাই অনুভূত হয়েছে চলচ্চিত্রপাড়ায়। তিনি একজন সৃজনশীল ও বাণিজ্যিক ধারার ব্যতিক্রমী সংমিশ্রণই ছিলেন না, চিত্রজগতের অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ।
কণ্ঠের লড়াইয়ে যোগ্য সেনাপতি ছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকনও। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বরপুত্র ছিলেন এই মেধাবী নির্মাতা। একটা যুগ শাসন করেছেন শহীদুল ইসলাম খোকন। যার নামে ছবি বিক্রি হয়েছে, যার টানে দর্শক ছুটেছে, যাকে দৃষ্টান্ত মেনেছে নতুন প্রজন্মেও নির্মাতারা, সেই খোকনও লড়াই করতে করতে মেনে নিলেন মৃত্যুকে।
হুমায়ূন আহমেদ, শহীদুল ইসলাম খোকন, চাষী নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, তারেক মাসুদসহ আরো কয়েকজন চলচ্চিত্রকারকে আমরা হারালাম খুব কাছাকাছি সময়ে। এ যেন মৃত্যুর মিছিলে শামিল হওয়ার হুড়াহুড়ি। একেকজনের দখল ছিল একেক বিষয়ে। এককজন ছিলেন একেক দিকে সেরা। সেরাদের এই হারানোর মিছিলে ভিড়ে যাওয়ার দৃশ্য বেদনার কারণ হয়েছে সংস্কৃতিসেবীদের। রতœভান্ডার চোখের সামনে লণ্ডভণ্ড হওয়ার যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস এনেছে তাদের মৃত্যুর মিছিল।
একজন মিজু আহমেদের দেয়ার ছিল আরো। রাষ্ট্র তার প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করে। তার মূল ক্ষেত্র নেতিবাচক অভিনয়ে তিনি নিজস্বতার পরিচয় রেখেছিলেন। বেশুমার ছবিতে তিনি অভিনয় করে গেছেন। হয়তো করতেন আরো ছবিতে অভিনয়। যে চরিত্রগুলো তার করা হয়নি, যে চরিত্রগুলো করলে তাকে দর্শক নতুন করে আবিষ্কার করতেন, তার প্রতিভার নবমূল্যায়নে ব্যস্ত হতেন, মৃত্যু মিজু আহমেদকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করল। মিজু আহমেদের চলচ্চিত্রসঙ্গী, ব্যবসায়িক অংশীদার, নব্বই দশকের আরেক জাদরেল অভিনেতা রাজিব আরো এক যুগ আগেই চলে গেছেন। তার চলে যাওয়া ছিল অকালেই। যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতার চৌকাঠে বসে, তখনই তাকে আসন ছেড়ে উঠে যেত হলো চিরতরে। এ দেশে মন্দ মানুষের অভিনয়কে যারা পেশাগত উৎকর্ষ দিয়েছিলেন, রাজিব তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাকে হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ারই নয়। মিটিয়ে নেয়ার মতো নয় হুমায়ুন ফরীদির প্রস্থানও। রাজকীয় অভিনয়ের অঘোষিত যুবরাজ ফরীদিরও এত দ্রুত চলে যাওয়ার কথা ছিল না। আশির দশকে মঞ্চে, টেলিভিশনে আর নব্বই দশকে তিনি যে সুধা ঢেলে দিয়েছিলেন পর্দায়, তার স্বাদ এত তাড়াতাড়ি দর্শকের ভোলার কারণ নেই। ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় এই বহুমুখী অভিনেতাকেও। তবু ভুলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় রাস্তা মরণের দিকেই আচমকা হেঁটে গেলেন এই চির অভিমানী অভিনেতা। চলে গেছেন শক্তিমান অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানও।
এ টি এম রাজিব, মিজু আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি- যারা তৈরি হয়েছিলেন সত্তরে, বিকশিত হয়েছিলেন আশিতে, নিজেদের উজার করে দিয়েছিলেন নব্বইয়ে- তাদের এই হঠাৎ বিদায়ের সফরে অংশগ্রহণ বেদনার পাহাড় চাপিয়েছে অভিনয় জগতে। খল অভিনয়ের তিন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার একে একে বিদায়ে তৈরি হয়েছে বিরাট শূন্যতা।
পরিচালক কিংবা খল নায়করাই শুধু বিরহের গানে সুর তুলছেন না, চরিত্রাভিনেতারাও যাচ্ছেন প্রকৃতির রীতি মেনেই। প্রথমে গেলেন গোলাম মুস্তাফা, এককালের সুদর্শন নায়ক ও ডাকসাইটে অভিনেতা। তারপর গেলেন শওকত আকবর, আকর্ষণীয় দৈহিক গঠন ও মেজাজি অভিনয়ের সুপুরুষ। তারপর যাওয়ার পালা আনোয়ার হোসেনের, এক ধ্যানমগ্ন ব্যস্ত অভিনেতা। তাকে সঙ্গত করলেন খলিল, ভালো-মন্দ দুই চরিত্রেই যার অবলম্বন গগনবিদারী কণ্ঠ। মাঝখানে, এক ফাঁকে চট করে নিজেকে সরিয়ে নেন দিলদার। যার বিকল্প কখনো আসবে- এটাই কেউ ভাবতে হিমশিম খান। চলে গেছেন চলচ্চিত্রের মিয়াভাইখ্যাত ফারুকও।
চলচ্চিত্রে এখন যেন মেধাশূন্য হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে! যারা একসময় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, প্রতিভাত হয়েছেন, তারা ফুরিয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে। একদল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। আরেক দল বয়সের ভারে নত হয়ে পড়েছেন। যেখানে ধীরে ধীরে সবার যাওয়াই স্থির, এখানে ঘটছে উল্টো। গুণী মানুষগুলো গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের। আর তাদের শূন্যতা বেশি করেই বাজছে যখন এই শূন্যতা পূরণের কোনো লক্ষণরেখা ফুটে উঠছে না। ফরীদি, মিজু, রাজিবের শূন্যতা কারা পূরণ করবে, কবে পূরণ করবে, কীভাবে পূরণ করবে, এই প্রশ্নগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে চলচ্চিত্রের মানুষদের। কোথায় মিলবে আরেকজন হুমায়ূূন, কে নেবে চাষীর জায়গা, কোন পদ্ধতিতে হবে নতুন খোকনের জন্ম, এই প্রশ্নগুলোর জবাব নেই কারো কাছে। স্বাধীনতাপূর্ব যুগের এবং স্বাধীন বাংলাদেশের গুণী চলচ্চিত্রশিল্পী-নির্মাতা-কুশলীরা এখন বিকাশের পথ ছেড়ে ধরেছেন বিদায়ের পথ।