১৫টি স্থানে ডাইক ভেঙে ঢুকছে পানি
বর্ষণ ও ঢলে ভয়াবহ বন্যার কবলে সিলেট

খালেদ আহমদ, সিলেট থেকে
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উজানে ভারি বর্ষণে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে ডাইক (নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ) ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা দিয়ে নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এর মধ্যে জরুরি বৈঠক করেছে।
এদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিলেটের অধিকাংশ পর্যটন স্পট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয়দের সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন গতকাল দিনভর খাবার ও নগদ অর্থ নিয়ে বানভাসী মানুষের পাশে ছিল। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীর কয়েকটি টিমকে বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করতে দেখা গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি আগে থেকেই ছিল বিপৎসীমার ওপরে। বুধবার রাতে ভারতের মেঘালয় থেকে আরো ঢল নামতে শুরু করে। এ সময় জকিগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৪-৫টি স্থানে কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে প্রবল বেগে লোকালয়ে পানি ঢুকে যায়। তাছাড়াও অন্তত এক কিলোমিটার এলাকায় নদী উপচে পানি প্রবেশ করে। ওই উপজেলার সুরমা নদীর বেড়িবাঁধগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় ডাইক ভেঙে পানি ঢুকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, কুশিয়ারা নদীর অন্তত ১৫ স্থানে নদী প্রতিরক্ষা বাঁধ (ডাইক) ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। তাছাড়া অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি বাঁধ উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের টিম কাজ করছে। কিন্তু প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙা ডাইক মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, কুশিয়ারার বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করলেও সুরমায় এখন পর্যন্ত কোথাও ভাঙনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন স্থানে নদী উপচে পানি প্রবেশ করছে।
এদিকে প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গত বুধবার বিকাল থেকে এসব উপজেলায় হু হু করে বাড়তে শুরু করে পানি। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন অন্তত তিন লক্ষাধিক মানুষ। রাতে অনেকের ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। ভেসে যায় গবাদি পশু ও পুকুর-খামারের মাছ। কোনো কোনো ঘরে গলা পর্যন্ত পানি উঠে। এ অবস্থায় দিশেহারা ও আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটেন বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষ। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কসহ এই চার উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক। এতে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। যান চলাচল বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন সড়কে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ- এই ৫টি উপজেলায় মোট ২১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে বুধবার বিকাল থেকেই মানুষ উঠতে শুরু করেন।
গতকাল কোথাও কোথাও পানি কিছুটা কমলেও মানুষজন ভয়ে বাড়ি ফিরছেন না। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তাই নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্রে আসছেন অনেকে। বন্যাকবলিত লোকজনের জন্য গতকাল জেলা প্রশাসন থেকে ২০০ বস্তা করে মোট ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ৫০ হাজার টাকা করে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সিলেটের জাফলংয়ে ৩৫৫ মিলিমিটার। এছাড়া জেলার লালাখালে ১৫০, কানাইঘাটে ৭৯, জকিগঞ্জ ৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সিলেটে বৃষ্টিপাত ও ভারতের বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলেই সিলেটের নদনদীর পানি দ্রুত বেড়ে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানিয়েছেন, উপজেলার উঁচু এলাকা ছাড়া সব প্লাবিত, কোথাও কোথাও মানুষের বাড়ির চালা পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। বুধবার রাতে প্রবল স্রোতে উদ্ধার অভিযান ভালোভাবে পরিচালনা করা না গেলেও ভোর ৪টা থেকে পুরোদমে উদ্ধার অভিযান চলছে। উপজেলার ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়েছে।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, বন্যায় উপজেলার ৮০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলছে। উপজেলার ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ২৫০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক মানুষ পার্শ্ববর্তী উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় উপজেলার সব পর্যটন স্পট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন বলেন, জেলা ও উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এর মধ্যে বৈঠক করেছে। দ্রুত উদ্ধার অভিযান চলছে। বুধবার রাত থেকেই পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী।