মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার
চরম বিপাকে হাজারো শ্রমিক

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

- শাহজালালে দুর্ভোগের ষোলকলা
- ৩০ হাজারের টিকেট সোয়া লাখ
- ৩১ হাজার কর্মীর যাত্রা অনিশ্চিত
নরসিংদীর সিরাজুল ইসলামের (ছদ্মনাম) মালয়েশিয়া যেতে গড়পড়তা হাজার ত্রিশেক টাকা বিমানের ভাড়া বাবদ খরচ হয়। কিন্তু গতকাল মালয়েশিয়া যেতে তিনি টিকেট কেটেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। আগে থেকেই দেশটিতে থাকা সিরাজুল ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার নতুন নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে প্রায় চারগুণ টাকা বেশি খরচ করে মালয়েশিয়া যেতে ঘর থেকে পা বাড়িয়েছেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢোকার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হবে তা আগে টের পাইনি।
মানিকগঞ্জের জাফর আলী (ছদ্মনাম) গতকাল শুক্রবার ঢাকার পল্টন, বিজয়নগর ও আরামবাগ এলাকায় দিনভর ছোটাছুটি করেও মালয়েশিয়া যাওয়ার একটি টিকেট জোগাড় করতে পারেননি। তিনি বলেন, শেষমেশ টিকেটের দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রাজি হলেও পাইনি। এত টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া কেন যাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে তো কাজ নেই। মালয়েশিয়ার ভিসা পেয়েছি, যাব না? টিকেট না পেয়ে বিষণ্ন মনে মানিকগঞ্জ ফিরে যাওয়ার বাসে উঠে পড়েন। যাওয়ার আগে তার শেষ উক্তি, ‘কপালটা খারাপ’।
ঢাকার পল্টনের এক মানবসম্পদ ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের ভোগান্তির ষোলকলা পূর্ণ হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া সংক্রান্ত ঘোষণায় মালয়েশিয়া জানিয়েছিল, দেশটিতে যেতে একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের সাকুল্যে ৮০ হাজার টাকা খরচ হবে। কিন্তু দেশটি যখন জানায়, ৩১ মের পর বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের শ্রমিকরা মালয়েশিয়া যেতে পারবেন না; তখনই মহাসংকট তৈরি হয়। এই সংকটের ফলে একজন শ্রমিকের মালয়েশিয়া যেতে সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচা হচ্ছে। এরমধ্যে ৩০ হাজার টাকার টিকেটের দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ১০ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে।
তবু শ্রমিকরা বেশি টাকা দিয়েই টিকেট কিনতে থাকেন। তবে বেশি দামে টিকেট বেচতে পারলেও ওই মানবসম্পদ ব্যবসায়ীর ভাষ্য অনুযায়ী প্রতি টিকেটে খুব একটা লাভ হয়নি। কেন লাভ হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি টিকেট থেকে সিন্ডিকেটসহ নানা জায়গায় ‘ভাগ’ দিতে হয়েছে। ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিজের পকেটে বেশি টেকেনি। তারমতে, শ্রমিকরা বেশি টাকা দিয়ে টিকেট কিনে কেউ সিঙ্গাপুর হয়ে, কেউ ভারত হয়ে, কেউ কম্বোডিয়া হয়ে মালয়েশিয়া গেছেন। যারা যেতে পারেনি তাদের ভিড়ই বিমানবন্দরে দেখা গেছে। তবে তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ তারা চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়া যেতে পারেননি প্রায় ৩১ হাজার বাংলাদেশি। গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে দেশটিতে যাওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগে বিমানের টিকেট করতে না পারায় ভিসা থাকার পরও তারা যেতে পারেননি বলে জানা গেছে। ফলে তাদের এবারের মতো মালয়েশিয়া যাওয়া আর হলো না।
এর আগে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করতে থাকেন মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা। উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় পার করতে থাকেন তারা। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে শুক্রবারের পর বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশ থেকে কোনো কর্মীকে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। গত জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ
এ সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি পুনরায় করার অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কর্মী যায় মালয়েশিয়ায়। আপাতত মালয়েশিয়া সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।
গত ২৯ মে মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনার হাসনা মোহাম্মদ হাসিম সাংবাদিকদের জানান, বিদেশি কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন ছুটিতে বাংলাদেশে আসা প্রবাসী কর্মীরাও। অন্যদিকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মালয়েশিয়াগামী ফ্লাইটগুলোর টিকেটের দামও বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
এরই মধ্যে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের জন্য শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইট চালিয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. আল মাসুদ খানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিমানের ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে একটি বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইট চালানো হয়েছে। ফ্লাইটে মোট ২৭১ জন যাত্রী ছিলেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানসহ সাতটি ফ্লাইট চালানো হয়েছে। কিন্ত এসব ফ্লাইটে ঠিক কতজন মালয়েশিয়া গিয়েছেন তার পরিসংখ্যান আপাতত জানা যায়নি।
তবে বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ কর্মীদের অভিযোগ, এজেন্সিগুলো টিকেট ম্যানেজের আশা দিয়ে শেষ সময়ে এসে প্রতারণা করছে। অনেকের ফোন ধরছে না, যোগাযোগ করছে না। অনেককে আবার পরবর্তী ফ্লাইটের আশা দেয়া হচ্ছে। এর ফলে ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট থাকা সত্ত্বেও তারা আদৌ যেতে পারবেন কিনা জানেন না। অনেকরই অভিযোগ টিকেট পাইয়ে দিতে তাদের কাছ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত টাকা বেশি নেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের দাবি প্রবাসী কর্মীদের।
তাদের দাবি, হয় সময় বাড়ানো হোক নতুবা তাদের টিকেটের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। এর আগে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। ২০২২ সালে আবারো শ্রমবাজার খোলার পর ৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি সেখানে গেছেন। সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। বর্তমানে ১২ লাখের বেশি কর্মী রয়েছেন দেশটিতে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল থেকে এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে গেছে মালয়েশিয়াগামী ৭টি ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটে যেতে পারছেন দেড় হাজার কর্মী। জানা গেছে, যারা সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় ওয়ার্কার ভিসা (কর্মী ভিসা) পেয়েছেন তাদের এ বছরের ৩১ মের মধ্যে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে দেশটির সরকার।
এ বিষয়ে গত ১৬ মে পত্রিকায় জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সবাইকে জানালেও বাংলাদেশে অবস্থানরত অনেক প্রবাসী কর্মী বিষয়টি জানতেন না। পরে ২০ মের পর বিষয়টি জানাজানি হলে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার তাড়াহুড়ো পড়ে যাওয়ায় ফ্লাইট সংকট দেখা যায়। ফলে অনেক প্রবাসী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি।
এদিকে মালয়েশিয়ার দৈনিক দ্য স্টার জানিয়েছে, মালয়েশিয়া ঢোকার শেষ দিনে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক অস্বস্তিতে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনুমোদিত ৩১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার কেএল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (কেএলআইএ) টার্মিনালগুলোতে জনজট দেখা দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ হাজারসহ ১৪টি দেশের প্রায় ২০ হাজার কর্মীর নিয়োগকর্তা তাদের শনাক্তকরণের অপেক্ষায় দুটি টার্মিনালের মধ্যে আটকা পড়েছেন। শ্রমিকরা সেখানে নেমে নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না। ফলে সেখানে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র দ্য স্টারকে বলেছে, আমরা কখনই শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর কথা বলিনি। তবে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন। এর জন্য আমাদের সময় প্রয়োজন।
এদিকে অভিবাসী শ্রমিকদের আগমন সামলানোর জন্য মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ অভিবাসন কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়িয়েছে, অতিরিক্ত কাউন্টার খুলেছে এবং অপেক্ষমাণ কর্মীদের খাবার ও পানি সরবরাহ করেছে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) দাতুক রুসলিন জুসোহ বলেছেন, সাধারণত বিমানবন্দর হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ থেকে ১ হাজার বিদেশি কর্মী মালয়েশিয়া আসতেন। কিন্তু সেটি গত ২২ মের পর থেকে ক্রমাগত হারে বাড়ছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, গত ২২ মে আড়াই হাজার এবং ২৭ মে দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার হাজার শ্রমিক এসেছেন। তিনি বলেন, এয়ারলাইন্সের তথ্যের ভিত্তিতে এটা বলা যায় মালয়েশিয়া ঢোকার শেষ দিনে এই সংখ্যা আরো বহুগুণ বাড়বে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মালয়েশিয়া যেতে না পারায় শ্রমিকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অ্যাসোসিয়েশন সব কর্মীকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভ্রমণের অনুমতি দেয়ার জন্য এক বা দুই মাস কর্মসূচি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু আলোচনার ফলাফল এখনো জানা যায়নি।