স্মার্ট বাজেটে যা যা থাকছে

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফের পরামর্শে রাজস্ব আয় বাড়ানোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়ে আগামীকাল ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সংকটকালের এই বাজেটে ব্যয়ের অঙ্ক না বাড়িয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জোর দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।
এ কারণে এবারের বাজেটের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে- ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। অর্থমন্ত্রী মোট ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন; যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে চার শতাংশের একটু বেশি।
বাংলাদেশে সচরাচর বাজেটের প্রবৃদ্ধি ১৩-১৪ শতাংশ হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে অর্থমন্ত্রী এবার সে পথে হাঁটেননি। ফলে অর্থনীতির ৭ শতাংশ বিকাশ আর ১০ শতাংশের কাছাকাছি মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নেয়া হলেও স্থিরমূল্যে বাজেটের আকার সংকুচিত হচ্ছে ১২ শতাংশের বেশি।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার প্রথম দিকে বাজেটের আকার আট লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এত বড় বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থের প্রয়োজন তা সঙ্কুলান করা রীতিমতো দুরূহ হয়ে পড়বে। এই বিবেচনায় বাজেটের আকার যাতে কোনো অবস্থায় আট লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করতে না পারে সে ‘সীমারেখা’ টেনে দেয়া হয়। তাই চূড়ান্ত পর্যায়ে আট লাখ কোটি টাকার নিচেই বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে বাজেটের আকারে কৃচ্ছ্রতা সাধনের চিত্রই ফুটে উঠেছে।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। এ বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি, টাকার অঙ্কে বাড়ছে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে যা ছিল দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপির আকার করা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। সেখান থেকে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি কমছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
প্রথম বাজেটের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়। পাশাপাশি নিত্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা এবং জীবনযাত্রার মান যেন সীমার মধ্যে থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা হবে।
প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রধান আয় হচ্ছে রাজস্ব আয়। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। নতুন রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারো বেশির ভাগ আয় করার দায়িত্বটি থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
এবার চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে হবে এনবিআরকে। নন-এনবিআর থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের চ্যালেঞ্জ থাকছে আগামী বাজেটেও।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি থাকছে অনুদানসহ ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিশাল ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে মোটা এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ। পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারি চাকরিজীবীদের ‘জিপিএফ’ থেকে নেয়া হবে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা। অবশ্য বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড় জোর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে অর্থমন্ত্রীর জন্য ৩২৯ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা তৈরি করা হয়েছে। অতীতে এত বড় বাজেট বক্তৃতা আর প্রণয়ন করা হয়নি বলে জানা গেছে। তবে এই বিশাল বাজেট বক্তৃতা ৮২ বছর বয়সি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে পুরোটা পড়তে হবে না। তিনি তার এই বাটেজেট সারাংশ স্লাইডের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করবেন।
জানা গেছে, বরাবরের মতো এবারো বাজেটের প্রথমাংশে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে। থাকবে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কথাও। এগুলোর জন্য দায়ী করা হবে কোভিড পরবর্তী ‘রাশিয়া-ইউক্রেন’ যুদ্ধকে। বলার চেষ্টা করা হবে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভ বাড়বে এবং কমবে মূল্যস্ফীতি।
কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। আর এই লক্ষ্য পূরণ করতে মূলত পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হতে পারে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত বা কমানো হতে পারে, অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর দিকনির্দেশনা থাকতে পারে, কিছু খাতে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে আনা হতে পারে, কমানো হতে পারে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ।