পদত্যাগ করছে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে ইসি
সংবাদ সম্মেলন আজ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কাজী হাবিবুল আউয়াল
অবশেষে পদত্যাগ করতে চলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য চার কমিশনার। আজ বৃহস্পতিবার জরুরি সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের এ সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশন সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনের পর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগপত্র তুলে দেবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন।
নির্বাচন ভবনে গতকাল বুধবার দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কক্ষে অন্য চার কমিশনারকে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আভাস দেন সিইসি। পদত্যাগ কবে করবেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আগামীকাল (আজ বৃহষ্পতিবার) এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাব। যা বলার আজ বৃহস্পতিবার ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কবে দেখা করবেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কালকে (আজ বৃহষ্পতিবার) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাব। তার আগেই আপনারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সবই জানতে পারবেন’।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছুদিন ধরেই পদত্যাগের গুঞ্জন চলছিল নির্বাচন কমিশনে। এদিকে নব গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইসি সংস্কারের কথা বারবার বলে আসছে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলও আওয়াল কমিশনকে আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট অভিযোগ তুলছে শুরু থেকেই। এ কারণে বর্তমান ইসির অধীনে নির্বাচনেও যায়নি তারা। ইসির পদত্যাগের দাবিতে অনড় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।
এদিকে ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন রাষ্ট্রের তৃতীয় পদধারী জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। পদত্যাগ করেছেন প্রধান বিচারপতিসহ দেশের বহু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ ঊর্ধ্বতনরা। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ ছিল সময়ের ব্যাপার। আজ সদলবলে সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকেই যাচ্ছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
এ বিষয়ে সিইসির একান্ত সচিব মো. রিয়াজ উদ্দিন ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন, পদত্যাগের সব প্রস্তুতি আগে থেকেই শেষ করে রেখেছেন সিইসিসহ পূর্ণ কমিশন। এ বিষয়ে আজ সংবাদ সম্মেলন করতে চান তিনি। এজন্য লিখিত একটি বক্তব্যের খসড়া নিজেই তৈরি করেছেন। সেখানেই পদত্যাগের বিষয়টি থাকবে বলে মনে হয়। তবে তিনি কখন কীভাবে পদত্যাগ করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি আমাকে বলেছেন, ‘নো কমেন্টস, কাল সংবাদ সম্মেলনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে পারবেন’।
রিয়াজ উদ্দিন জানান, এমন হতে পারে ইসি ভবন থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে তা রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠিয়ে দিতে পারেন, বা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে দেখা করে সেখানেই পদত্যাগপত্র জমাও দিতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার শিডিউল আজ বা কাল নেই বলেও জানান তিনি। যদিও সিইসি জানান, আজ বৃহষ্পতিবার তারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবেন।
এদিকে ইসির এক যুগ্ম সচিব জানিয়েছেন, সিইসি সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেও সংবাদ সম্মেলনের পক্ষে নন অন্য চার নির্বাচন কমিশনার। তারা সিইসিকে জানিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলনে তারা অংশ নেবেন না। সংবাদ সম্মেলনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হতে পারে। শেষ সময়ে সাংবাদিকদের নানা ধরনের ব্রিবতকর প্রশ্নের সম্মুখীন তারা হতে চাইছেন না। তারা পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে ইসি ভবন ত্যাগ করতে চান।
এর আগে গত ২৪ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সংস্কার-বিপ্লব ও ফরমান : সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে কলাম লেখেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। ওই কলামে তিনি দাবি করেন, আলোচনার জন্য তিনি কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। সিইসি দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংবিধান স্থগিত না করেই যেভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম চলছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন কমিশন ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়বে।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘বিপ্লবের উদ্দেশ্যসমূহকে এগিয়ে নিতে’ অসামরিক ফরমান জারি করে সংবিধান পুরোপুরি অথবা আংশিক স্থগিত করার আহ্বানও জানান তিনি। আর এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনাও হয়। প্রশ্ন ওঠে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান হিসেবে কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক সংকট নিয়ে কথা বলেন সিইসি; আসলে কী চান তিনি।
তারপরে বিগত ৫ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইসির পদত্যাগ নিয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। নির্বাচন কমিশনের দেয়ালে পদত্যাগের ব্যানারও সেটে দেন বিক্ষুব্ধরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করা হবে বলে জানান।
ইসি সূত্রে আরো জানা যায়, নেপালে শুরু হওয়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর নির্বাচন কমিশনারদের সংগঠন ফেমবোসার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি সিইসি। গত মঙ্গলবার তার নেপাল যাওয়ার কথা ছিল। আগামীকাল ৬ সেপ্টেম্বর দেশে আসার কথা। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে জিও জারি করা হয়। ওই জিও বাতিল করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
সূত্র জানিয়েছে, এছাড়া পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিইসি। ইতোমধ্যে বাসার মালামাল সরিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা খানম তার ব্যবহার করা সরকারি ট্যাব জমা দিয়েছেন। তবে বিদায়ের আগ মুহূর্তেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেবার ক্ষেত্রে ছাড় দেননি নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান। তার সরকারি লাল পাসপোর্টে ছয় মাসের জন্য সার্ক স্টিকার লাগিয়েছেন। অনেকদিন ধরে অফিস করছেন না ইসি আনিছুর রহমান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনার জানান, তাদের আরো কয়েকদিন দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা ছিল। ওই ইচ্ছার পক্ষে কমিশনারদের যুক্তি ছিল, সংসদ ভেঙে দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভোট গ্রহণের অন্তত ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করতে হয়। ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। ওই হিসেবে ২০ সেপ্টেম্বর নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা। তখন তফসিল ঘোষণা করতে না পারলে তারা পদত্যাগ করবেন। কিন্তু নাগরিক ঐক্য ও গণ অধিকার পরিষদের (জিওপি) নিবন্ধন দেয়া নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং নিবন্ধনপ্রত্যাশী দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের মারমুখী আচরণে এখনই পদত্যাগ করতে চান সিইসি। গত মঙ্গলবার কমিশনারদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় সিইসি তার এ অভিব্যক্তি জানান।
ওই নির্বাচন কমিশনার আরো জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিইসি নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। গত সোমবার বিকালে ড. রেজা কিবরিয়ার নেতৃত্বাধীন গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা নিবন্ধনের দাবিতে যেভাবে নির্বাচন সচিবালয়ের ভেতরে রুমে রুমে ঢুকে গণ্ডগোল, হাতাহাতি করেছেন তাতে বিব্রতবোধ ও অনিরাপদবোধ করছেন তিনি। এ কারণে গত মঙ্গলবার অল্প সময় অফিস করেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডিও করেছে ইসি।
এসব কারণে গত মঙ্গলবার থেকে নির্বাচন কমিশনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়ানো হয়। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও। এমন পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করার বিষয়ে অনড় অবস্থানে আছেন সিইসি। তার এ অবস্থান দেখে অন্য কমিশনাররাও পদত্যাগ করতে রাজি হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান। নিয়োগের একদিন পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কাছে শপথ নেন তারা।