বাজার বিশ্লেষণ
সিন্ডিকেটের শুধু মুখ বদল নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সিন্ডিকেটের শুধু মুখ বদল নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে। সংস্কার হচ্ছে বিভিন্ন খাতে। তবে সম্পূর্ণ উল্টোচিত্র নিত্যপণ্যের বাজারে। চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটে হয়েছে কেবল মুখবদল। ফলে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে এখনো পকেট কাটছে ভোক্তাদের। আগের সরকারের পথ ধরে বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু বাস্তবে সেই একই চিত্র; বেঁধে দেয়া দামে মিলছে না পণ্য। নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা বলছেন, কোনো একটি ইস্যু বা অজুহাত পেলেই দাম বাড়িয়ে দেন বিক্রেতারা। আর তাতে পকেট কাটা হয় ভোক্তাদের।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যবসায়ীরা বরাবরই সুযোগসন্ধানী। সিন্ডিকেট শুধু খোলস আর কৌশল পাল্টেছে, স্বভাব বদলায়নি। সিন্ডিকেটে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। বাজারে স্বস্তি ফেরাতে এখনই সময় সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়। ক্ষমতা নিয়েই বাজার সিন্ডিকেটসহ নানা অনিয়ম ও আর্থিক খাত সংস্কারের ঘোষণা দেয় এ সরকার। সম্প্রতি অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম কমাতে এর মধ্যে শুল্ক প্রত্যাহারসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে একবারে তাদের দৌরাত্ম্য কমবে না। আস্তে আস্তে তাদের দমন করা হবে। অবশ্য উপদেষ্টার আশ্বাসের কোনো প্রভাব বাজারে নেই বললেই চলে। সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে ডিম আর মুরগির দাম। পেঁয়াজের দামও বাড়তি। কিছু সবজির দাম কমলেও কোনো কোনো সবজির দাম আবার বেড়েছে। তবে ভোজ্যতেলের দাম স্থিতিশীল আছে।
এর আগেও বিভিন্ন সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোগ্যপণ্যের দাম বেঁধে দিতে দেখা গেছে তৎকালীন সরকারকে। গত বছর সেপ্টেম্বরে আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু ওই দাম বাজারে কার্যকর হয়নি। এর জন্য বাজার মনিটরিংকে দায়ী করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়াই যেন সরকারি সংস্থাগুলোর প্রধান কাজ। এরপর বাজার মনিটরিংয়ে তাদের খুব একটা দেখা যায় না। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কয়েকদিন পরই আবার বাড়তে শুরু করেছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। এর কারণ বাজারের পুরনো খেলোয়াড়রা আবার সক্রিয় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। নাজের বলেন, মানুষের দৈনিক চাহিদা, পণ্য উৎপাদন ও এর সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা ছিল কৃষি অধিদপ্তরে কাজ। কিন্তু তারা এতে অনেক বেশি পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া, খাদ্য ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার জন্য দেশের পোলট্রি খাতের অস্থিরতা কমছে না। এর জন্য সরকারও তাদের বেঁধে দেয়া দাম কার্যকর করতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে ছাত্র-জনতাকে আবারো সক্রিয় হতে হবে। সরকার পতনের পর ছাত্ররা যেভাবে বাজার তদারকি করেছিল, সেটি আবারো নিয়মিত করা যেতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটকারীদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। এখনই সময় বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার।
বাজারে দেখা গেছে, মোটা চাল কেজিতে পাঁচ-ছয় টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকা দরে। মিনিকেট চালের দামও কেজিতে ছয় টাকা বেড়েছে। নতুন ধান উঠতে আরো এক দেড়-মাস লাগবে। সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে চালের বাজার আরো অস্থির হতে পারে বলে মনে করেন খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা।
আলু আর পেঁয়াজের দাম কয়েক মাস ধরেই অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। আলুর কেজি এখন ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া আলু আমদানিতে থাকা তিন শতাংশ এবং পেঁয়াজ আমদানিতে থাকা ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারত থেকেও পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। তারপরও কমছে না এ দুইটি পণ্যের দাম। তবে ভারত থেকে কম দামে আমদানি করায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের দামে সামান্য কিছু প্রভাব পড়েছে। ভারতীয় পেঁয়াজ কেজিতে ৫ টাকা কমে পাইকারিতে ৮৫ টাকা ও খুচরা পর্যায়ে ৯০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, আগে পেঁয়াজ কেজিতে বিক্রি করেছিলাম ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছি। আমদানি বাড়লে আরো দাম কমতে পারে। এক ক্রেতা বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যে আজকে পেঁয়াজ কেজিতে কিনলাম ৮৪ টাকায়। পেঁয়াজের বাজার একটু আগের কিছুটা কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না বাড়লে বাজারে দামের তেমন প্রভাব পড়বে না। আমদানির খবরে দুই থেকে চার টাকা কমলেও আবারো পেঁয়াজের দাম বাড়তে পারে।
এর আগে ভারত সরকার বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নির্ধারিত মূল্যে প্রতি টন ৫৫০ ডলার থেকে কমিয়ে ৪০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে। আর শুল্ক ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ২০ শতাংশ।
ভোগ্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে স¤প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু নির্ধারণের চারদিন পার হলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। নতুন দাম অনুযায়ী প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা, সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা এবং প্রতিটি ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয় ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। এতে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়ে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। এদিকে ডিমের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে ২ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ ডিম দেশের বাজারে এসেছে। তাতেও যেন পুষ্টিসমৃদ্ধ এ পণ্যটির দাম কমছে না। উল্টো সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি ডজন ডিমে ২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সম্প্রতি দেশের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় কয়েকটি জেলায় পোলট্রি খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে ওইসব এলাকায় মুরগি ও ডিমের সরবরাহ কমেছে। তাছাড়া ভারত থেকে আসা ডিম চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত না হওয়ায় এ পণ্যের দাম কমছে না।
বাজারগুলোতে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ ও সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া ফার্মের মুরগির প্রতিটি ডিম ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ডজন বাদামি ডিম ১৬০ ও সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকার মধ্যে। সরকার নির্ধারিত দামে কেন বিক্রি হচ্ছে না জানতে চাইলে মালিবাগ রেলগেট কাঁচাবাজারের মুরগি বিক্রেতা কাওসার হোসেন বলেন, সরকার যতই দাম নির্ধারণ করে দিক না কেন, পাইকারি বাজারে দাম কমাতে না পারলে খুচরা বাজারে দাম বেঁধে দেয়ার কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ বেশি দাম দিয়ে কিনে কেজি প্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা লস দেয়া খুচরা ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী মিরাজ হোসেন বলেন, সরকার যখন কোনো ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়; তখন কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে না। এতে সরকারের বাজারবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত সফলতার মুখ দেখেনি। তিনি আরো বলেন, এর আগেও বহুবার সরকার ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করেছে। তাতেও সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য সবার আগে পাইকার ও উৎপাদকদের নীতিমালার আওতায় নিয়ে এলে ও তদারকি করলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে।
তবে খামারিরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত ডিম-মুরগির নতুন দামে লাভবান হবে করপোরেট গ্রুপগুলো। আর করপোরেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো গেলে ডিম-মুরগির দাম কমানো সম্ভব। আগস্টের বন্যায় দেশের ৭ জেলায় ৪ হাজার পোল্ট্রি খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে, ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, খামার পর্যায়ে যদি এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৬৯ টাকায় বিক্রি হয়, তাহলে সেখানে আরো ৩০ টাকা যুক্ত হয়ে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে। কিন্তু তারা মাত্র ৩ টাকা যুক্ত করেছেন। এটা বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার রেট যদি কমে যায় তাহলে দামও কমে যাবে। যত পার্সেন্ট ডলারের দাম কমবে তত পার্সেন্ট ব্রয়লারের দামও কমে যাবে। ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমানোর সুফল পেতে তদারকি বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ার তাগিদ এই ব্যবসায়ী নেতার। মাহবুবুর রহমান বলেন, খামার থেকে ডিম নিয়ে পাইকারিরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে থাকে। তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে বা অতিরিক্ত নজরদারিতে রাখতে হবে যাতে তারা ডিম বা ব্রয়লারের অতিরিক্ত দাম রাখতে না পারে।