ছাত্র রাজনীতি: নিষিদ্ধ নয়, শুদ্ধতায় সমাধান

মুহাম্মদ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার মধ্যে একটি দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরাও দাবি তুলেছেন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের। সেই দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা। গত বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার পর ঢাবি ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে বলেও জানানো হয়। এর আগেও শিক্ষার্থীদের একটি অংশের দাবির মুখে দেশের ৩৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি সরকারি কলেজ ও ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। কিন্তু ঢাবিসহ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সহজভাবে নিচ্ছেন না অনেকেই।
তাদের মতে, বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জল ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের পূর্বাপর অধিকার আদায় ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ছাত্র রাজনীতি- বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। এমনকি সবশেষ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানেও শিক্ষার্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আগামীতেও এই শিক্ষার্থীরাই সংকটে-সম্ভাবনায় জাতিকে পথ দেখাবে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না।
তবে কেউ কেউ মনে করেন দীর্ঘ সময় নয়; সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে সাময়িক সময়ের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যেতে পারে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারাও ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চাইছেন। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতন হিসেবে গড়ে তুলতে অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির দরকার আছে। ছাত্র রাজনীতির নামে দখলদারী ও সন্ত্রাস বন্ধে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সব ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্প্রতি বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি এতটা পচে গেছে- তা সাময়িক বন্ধ রাখা উচিত। আগামী দুই থেকে তিন বছর পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে ছাত্র রাজনীতিও উন্মুক্ত করা যেতে পারে।
এদিকে রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করতে সাবেক ছাত্রনেতাদেরও বড় একটি অংশের মত ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ রাখা উচিত হবে না। তবে শুদ্ধ রাজনীতি অবশ্যই দরকার বলে মত দেন তারা। এজন্য শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ও ছাত্রদের অধিকার বজায় রাখতে নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হওয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। এটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। আইয়ুব খান তা বন্ধ করেছিল। দেশে যখনই স্বৈরাচারের শাসন থাকে, তারা বলে রাজনীতি অনিষ্টের মূল। রাজনীতি বেশি হচ্ছে বলে সমস্যা নয়; কম হচ্ছে বলেই সমস্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের ‘খারাপ পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতি থাকতে হবে, রাজনীতিকে এক্সসেপ্ট করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ কোনো উত্তর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করছে, এটাকে আমি পুরোপুরি খারাপ পদক্ষেপ বলে মনে করি।
কারণ মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলে দিতে হবে, এটা কোনো সমাধান হতে পারে না, বরং কোথায় সমস্যা হচ্ছে সেটা সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। যে ছাত্র সংগঠনগুলো আছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করতে হবে। তবে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না, করা উচিতও না।
এটাকে বাদ দিতে কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে- এসব বিষয়ে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললেই সমাধান আসতে পারে। ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এক সময়ের সাবেক এই সভাপতি আরো বলেন, আমি তো মনে করি, ছাত্র রাজনীতি যদি সুস্থ না হয়, দেশের রাজনীতি সুস্থ হবে না। আর ছাত্র রাজনীতি থেকে যদি নেতৃত্ব তৈরি না হয় তাহলে জাতির নেতৃত্ব তৈরি হবে না। এটা হচ্ছে- ‘দ্যাট ইজ এ ব্রিডিং গ্রাউন্ড’, এখানে তৈরি হয়, এখানে রিক্রুটমেন্ট হয়।
বুরোক্রেসিতে বলেন, রাজনীতিতে বলেন সবকিছু তো এখান (ছাত্রদের) থেকে আসবে। আমাদের ছেলেপেলেরা যে রাজনীতিবিমুখ হয়ে গিয়েছিল তার কারণ হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চলে গিয়েছিল। এখন আবার তারা আসতে শুরু করেছে, এখন যদি আমরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেই তাহলে কার ভালো হবে? যারা অন্ধকারের মধ্যে কাজ করে তাদের জন্য ভালো হবে, যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে কাজ করে তারা লাভবান হবে। কাজেই ছাত্র রাজনীতি ওপেন রাখতে হবে। রাজনীতিকে এমনভাবে মোটিভেট করতে হবে যেন ভালো রাজনীতি হয়, সুস্থ রাজনীতি হয়।