জাতিসংঘের ব্যাপক সংস্কারে সমর্থন জানিয়ে যৌথ ঘোষণা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

১৬তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে নেতারা জাতিসংঘের সংস্কার থেকে শুরু করে চলমান বৈশ্বিক সংঘাতের বিস্তৃত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছেন। এতে গাজা উপত্যকায় চলমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিরও আহ্বান জানানো হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্য পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
রাশিয়ার কাজান শহরে ব্রিকসের দুদিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিন ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। এই সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ অন্য নেতারা অংশ নেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও সম্মেলনে যোগ দেন।
যৌথ ঘোষণাপত্রে মোট ১৩৪টি প্রবিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি জাতিসংঘের সংস্কার সংক্রান্ত। ঘোষণায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ এর ব্যাপক সংস্কারের প্রতি ব্রিকসের সমর্থন আবারো নিশ্চিত করা হলো- যাতে এটিকে আরো গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বমূলক, কার্যকর এবং দক্ষ করে তোলা যায়। বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব সম্প্রসারণও এর সঙ্গে জড়িত।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবৈধ একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাবের বিষয়ে আরো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্রিকস নেতারা বলেন, এটি নেতিবাচকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এবং দারিদ্র্য বাড়ায়। প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি ব্রিকস সদস্যরা জাতিসংঘকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশ্ব পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের আহ্বানও জানান।
ঘোষণায় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনসহ বৈশ্বিক সংঘাতের ওপরও আলোকপাত করা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং অব্যাহত সশস্ত্র সংঘাতের বিষয়ে ব্রিকস নেতারা উদ্বিগ্ন। কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মীমাংসায় তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
গাজা উপত্যকায় চলমান উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়। নেতারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার মধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব উল্লেখ করেন এবং জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। তারা একটি নতুন ব্রিকস বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানান- যা ব্রিকস দেশ এবং গেøাবাল সাউথের দেশগুলোয় বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়াতে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ব্যবহার করবে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চান পুতিন : ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্য পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে সতর্ক করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের অবসানে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়া বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, গাজায় এক বছর আগে শুরু হওয়ার সামরিক পদক্ষেপ বর্তমানে লেবানন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা তীব্রভাবে বেড়েছে। এই ঘটনা একটি ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পুরো মধ্যপ্রাচ্য পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
ফিলিস্তিনের বিষয়ে পুতিন বলেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন না হওয়া পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতার অবসান হবে না। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রধান শর্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত দ্বি-রাষ্ট্রীয় ফর্মুলার বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ঐতিহাসিক যে অবিচার হয়েছে, দ্বি-রাষ্ট্রীয় ফর্মুলা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার সুবিচার করতে হবে। এই প্রশ্নের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সহিংসতার দুষ্ট চক্র ভাঙা সম্ভব হবে না।
চীন সর্বদাই গেøাবাল সাউথকে ফোকাস করবে : চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ব্রিকস নেতাদের সংলাপে অংশ নিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন, চীন সর্বদাই গেøাবাল সাউথকে ফোকাস করবে। তিনি বলেন, চীন নিজের শিকড় গেøাবাল সাউথে স্থাপন করবে, ব্রিকসে যোগদানের জন্য গেøাবাল সাউথের আরো দেশকে সমর্থন করবে, গেøাবাল সাউথের শক্তিকে একত্রিত করবে এবং যৌথভাবে মানবজাতির অভিন্ন কল্যাণের সমাজের গঠনকে এগিয়ে যাবে। আমাদের উচিত সভ্যতা যোগাযোগ ও বিনিময়ের ইতিবাচক শক্তি হওয়া, পারস্পরিক সংলাপ বাড়ানো, বিভিন্ন দেশকে নিজ নিজ জাতীয় অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আধুনিকায়ন পথ বেছে নিতে সমর্থন করা। গেøাবাল সাউথ থিংক ট্যাংক সহযোগিতা অ্যালায়েন্স প্রতিষ্ঠায় চীন নেতৃত্ব দেবে, বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ও দেশ পরিচালনার বিনিময় প্রচার করবে।
মোদি-শি বৈঠক : ৫ বছর পর উত্তেজনা ভুলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গত বুধবার ব্রিকস সম্মেলনের এক ফাঁকে এই বৈঠক করেন দুই নেতা। বৈঠকে পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) সংঘাতের অবসান ঘটাতে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতাকে স্বাগত জানান তারা।
বৈঠকের পর মোদি বলেন, আমাদের বিশ্বাস, ভারত-চীন সম্পর্ক শুধু আমাদের জনগণের জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথনির্দেশিকা স্থির করবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, কাজানে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দেখা করতে পেরে আনন্দিত। ৫ বছর পরে আমরা নিজেদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসছি। শুধু আমাদের দুই দেশের মানুষরাই নন, আন্তর্জাতিক বিশ্বও আমাদের এই বৈঠকের দিকে সতর্ক নজর রাখছে।
চীন ও ভারত, উভয়েই যে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অন্যতম সে কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট শি বলেন, বিশ্বের দুটি প্রধান উন্নয়নশীল দেশ এবং গেøাবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে উভয় দেশই তাদের আধুনিকায়নের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্ব অতিক্রম করছে। এই পটভূমিতে দুই দেশ যদি তাদের ‘ইতিহাসের ধারা’ ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘সঠিক দিশা’য় থাকতে পারে, তাহলে তা উভয় দেশ ও উভয় দেশের মানুষের মৌলিক স্বার্থকে সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দুই দেশের মধ্যে যেন যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়ে, আমরা যেন নিজেদের মধ্যেকার মতবিরোধ ও মতানৈক্য ঠিকমতো সামলাতে পারি এবং আমাদের পরস্পরের ‘উন্নয়ন আকাক্সক্ষা’র বিকাশে সহায়তা করতে পারি সেটা আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও চীন উভয়ের জন্যই তাদের ‘আন্তর্জাতিক দায়িত্ব’ পালন করাটাও যে খুব জরুরি, সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দেন।
২০২০ সালের জুনে লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর থেকেই দুদেশের সম্পর্ক এক রকম তলানিতে ঠেকেছিল। তারপর এই প্রথম ভারত ও চীনের সর্বোচ্চ নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসলেন।
নরেন্দ্র মোদি ও শি জিনপিং শেষবার নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসেছিলেন ব্রাসিলিয়াতে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে। সেটাও ছিল একটি ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন, যার আয়োজন করে ব্রাজিল। মোদি-শি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওই সম্মেলনের এক ফাঁকেই। গত বছরের আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে এবং সেপ্টেম্বরে দিল্লির জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন মোদি ও শি। তবে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়নি।
ব্রিকস সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব : ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে গত বুধবার রাশিয়ার কাজান শহরে যান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘ মহাসচিবের উপমুখপাত্র ফারহান হক এদিন নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই বসবাস করে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলোয়। তাই জাতিসংঘের কাছে এই জোটের সম্মেলন স্বাভাবিক কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এই সম্মেলনে জোটের সব সদস্যের সরকারপ্রধানরা এসেছেন এবং তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সুযোগও রয়েছে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করেই মহাসচিব সম্মেলনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে গঠিত ব্রিকস জোটের সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা মোট ১১টি। রাষ্ট্রগুলো হলো- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব। প্রথম ৫টি রাষ্ট্রের নামের অধ্যাক্ষর দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে এ জোটের।