ট্রাম্প-কমলায় নজর রাখছে বাংলাদেশও

ঝর্ণা মনি
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

একেবারেই দোরগোড়ায় মার্কিন নির্বাচন। একদিন পরই ভোট। ২০০০ সালের জনমত জরিপ যেমন আভাস দিয়েছিল- এবারো একই রকম আভাস রয়েছে- হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের মধ্যে। প্রায় সব জরিপই বলছে তাদের ভোটের ব্যবধান হবে একেবারে সামান্য। কোথাও ট্রাম্প এগিয়ে, কোথাও কমলা। নির্বাচনী আমেজে ঘুম হারাম ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান শিবিরের।
আর এই দুই শিবিরের মতোই তামাম দুনিয়ার দৃষ্টি এখন সুদূর মার্কিন মুল্লুকে। ট্রাম্প-কমলার নির্বাচনী ব্যারোমিটারে নজর রাখছে বাংলাদেশও। ট্রাম্প বা কমলা যিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে- এর ওপর অনেকটাই নির্ভর করে দেশের অর্থবাণিজ্য থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের সরকার যেমন তাকিয়ে রয়েছেন মার্কিন নির্বাচনের দিকে; তেমনি তাকিয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপিও। বিএনপির নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার আন্দোলন নির্ভর করবে এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। আর সুতোয় ঝুলতে থাকা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাগ্যও কিছুটা নির্ভর করছে ট্রাম্প নাকি কমলা আসবেন- এর ওপর। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে কোনো চ্যালেঞ্জে ফেলবে না বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মূলত, মার্কিন নির্বাচনের দিকে সব সময় দৃষ্টি থাকে বাংলাদেশের। তবে এবার হাজার হাজার মাইল দূরের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের নজর একটু বেশিই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশের দায়িত্ব নেন ওয়াশিংটনের পুরনো মিত্র হিসেবে পরিচিত নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্লেষকদের মতে, জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক দল অর্থাৎ কমলা হ্যারিস জয়ী হলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। তবে ট্রাম্প শিবিরের ক্ষেত্রে সে মিত্রতার চিত্র কেমন হবে- তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
অন্যদিকে, গত শুক্রবার রাতে এক্সে দেয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বার্তা যাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-বিশ্লেষণ। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
তার এই বার্তা ঢাকাসহ সারাদেশে কম চাঞ্চল্য তৈরি করেনি। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিবেচনায় এ বার্তা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কেউ কেউ বিষয়টি লবিস্ট ফার্মের ভূমিকা এবং হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার অংশ হিসেবে দেখছেন। ফলে, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্ক জোরদারের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে বলেও মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, আমেরিকার নির্বাচনে যিনিই জয়ী হোন না কেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় আকারের পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন চায় ওয়াশিংটন- এটি তারা স্পষ্ট করেছে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশ নয়; ভারতের দিকেই আগ্রহ বেশি। আর ভারত সব সময় রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে থাকে। ওদিকেই বেশি আগ্রহ। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যদি আরো বেশি জোরদারের চেষ্টা করেন, তাহলে বাংলাদেশের দিকে খুব একটা নজর থাকবে না। তার নজর ভারতের দিকেই থাকবে বলে মনে করেন এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কবে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে ২০২৫ সালে নির্বাচন হতে পারে
এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন কেউ কেউ। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। অন্যদিকে, বড় প্রশ্ন হলো- আওয়ামী লীগ রাজনীতি করার বা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে কিনা? বিশ্লেষকদের মতে, এ দুটি ক্ষেত্রেই আমেরিকার নির্বাচনের ফল প্রভাব রাখতে পারে।
এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক এম সফিউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ অনেক দূরে, ছোট দেশ। এরপরও আমেরিকার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণ বঙ্গোপসাগর, তেল-গ্যাস। আর তিনদিকে ভারত, চীনও নিকটতম প্রতিবেশী। এসব কারণেই বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ চায় গণতন্ত্র। আমেরিকাও চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র।
এদিক থেকে সম্পর্ক তো রয়েছেই। যদিও বিগত সরকারের শেষ পাঁচ বছরে আমেরিকার সঙ্গে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, একেবারেই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল। ড. ইউনূস ক্ষমতায় এসে বাইডেন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য কাজ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় আমেরিকা। আমি মনে করি, বাইডেনের দল তথা কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় এলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক আরো জোরদার হবে, উন্নত হবে।
অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন- যা অতিরঞ্জিত এবং এটি আমাদের দেশের বিপক্ষে যায়। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছিল, ফলে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, এটি সবার ক্ষেত্রেই, কোনো কমিউনিটির ওপর আলাদাভাবে নয়। ট্রাম্প রাজনৈতিক উদ্দেশে ওই মন্তব্য করেছেন। ফলে এটি স্পষ্ট যে, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়বে।
সম্পর্ক চ্যালেঞ্জে ফেলবে না : মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প- যেই জয়ী হোক না কেন, আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক চ্যালেঞ্জে ফেলবে না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল শনিবার রাজধানীর এফডিসিতে মার্কিন নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসি আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। শফিকুল আলম বলেন, প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিক দুই পার্টিরই সিনিয়র লিডারদের খুব ভালো সম্পর্ক। প্রধান উপদেষ্টার বন্ধু দুটি দলের মধ্যেই আছেন। সম্পর্ক অনেকখানি নির্ভর করে ব্যক্তিগত অ্যাটাচমেন্টের ওপর। ড. ইউনূস একজন গ্লোবাল লিডার।
সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যটি সম্পূর্ণ ডোমেস্টিক পলিটিক্যাল ইস্যু। লবিস্টরা হয়তো এ বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ইউনিটি কাউন্সিল ৯ জন সংখ্যালঘু মারা যাওয়ার বিষয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে- তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এখানে রিলিজিয়াস মোটিভিশনের চাইতে পলিটিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন বা অন্য কোনো কারণ ছিল।