স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে গতি নেই

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার অসম্ভব, ঢেলে সাজাতে হবে- দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কয়েকবারই এমন মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব নেয়ার পর একই সুরে কথা বলেছেন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর। এছাড়া সংস্কারপন্থি অনেক সংগঠন ও চিকিৎসকরাও ওই একই কথা বলেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও কমিশন গঠন করলেও সংস্কার কাজে গতি নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তা এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের ধীর গতি নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও। সম্প্রতি সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) আন্দোলনে আহতদের দেখতে গিয়ে সেখানকার চিকিৎসায় নানা দুর্ভোগ ও অনিয়ম দেখে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘এই মুহূর্তে সবচেয়ে অ্যাক্টিভ উপদেষ্টা হওয়ার দরকার ছিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টার। আমাদের জায়গা থেকে বারবার স্পষ্টভাবে বলেছি, তাদের আসলে যেভাবে যতটা অ্যাক্টিভভাবে কাজ করার কথা, অতটুকু দেখতে পাই না।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাস্থ্য খাতের নানা বিষয় সংস্কারে বিভিন্ন সময় অর্ধশতাধিক সুপারিশমালা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। তবে বিগত সরকারের আমলে এসব সুপারিশের মধ্যে যেসব বিষয় শুধু ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করে, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা চলছে খুবই ধীরগতিতে যা বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে।
দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মান উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করার জন্য সরকার গত ৩ সেপ্টেম্বর বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করে। ১১ সদস্যের এই প্যানেলের সভাপতি করা হয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজকে। কমিটি গঠনের পর নানা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদ থেকে পদত্যাগ করেন অধ্যাপক ডা. ফয়েজ। এরপর ১৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্যসহ ৪টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। স্বাস্থ্য কমিশনের প্রধান করা হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানকে। প্রজ্ঞাপন না হলেও মৌখিক ভাবে বিশেষজ্ঞদের প্যানেল প্রধানের দায়িত্বও দেয়া হয়েছে অধ্যাপক ডা. আজাদ খানকে।
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কমিশনের মেয়াদ গেজেট প্রকাশের দিন থেকে ছয় মাস। কমিশন প্রধান এবং এর সদস্যরা পূর্ণকালীন হিসেবে কমিশনে কাজ করছেন। এই সময়ে তারা অন্য কাজ থেকে বিরত থাকবেন। তাদের কাজের জন্য অফিস এবং সাচিবিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তারা প্রতিবেদন দেবেন প্রধান উপদেষ্টাকে। ৩১ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছিলেন, রবিবারের মধ্যে এসব কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।
কোনো সরকারই স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ করেন অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস, বাংলাদেশের (এএইচআরবি) আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম যে কয়টি কমিশন করেছেন- সেই তালিকায় ছিল না স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। অথচ এই দুটি খাত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ। আগের সরকারগুলোও স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমিশন হয়নি। এই সরকার কমিশন গঠন করায় আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। কমিশন গঠনের ১৫ দিন পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে এখনো গেজেট হয়নি। কমিশন কাজ শুরু করতে পারেনি। সরকার সংস্কারের কথা বললেও আপাত দৃষ্টিতে এ বিষয়ে কোনো কাজই দৃশ্যমান নয়।
তবে আমরা আশাবাদী। দেশের প্রেক্ষাপটে কী পরিবর্তন হবে তা আমরা জানি না। তবে আলোচনা শুরু হোক। দ্রুত কাজ শুরু হোক। একটি কাঠামো থাকলে যে সুবিধা হয় তা হলো- বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যে কথাগুলো আমরা বলছি তা ধারণ করার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম থাকে। তবে বিশেষজ্ঞদের প্যানেল ও কমিশন আলাদা না রেখে দুইয়ের সমন্বয়ে শক্তিশালী কমিশন গঠনের পক্ষে ড. আব্দুল হামিদ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও এএইচআরবির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের কাগজকে বলেন, একদিকে কমিশন হলো। আবার বিশেষজ্ঞদের প্যানেলও হলো; কিন্তু সরকার কীভাবে কী করতে চাইছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। একজনকে কমিশনের দায়িত্ব দেয়া হলো। কাজের জন্য তাকে সদস্য দিতে হবে। নাকি বিশেষজ্ঞ প্যানেলই কমিশনের সদস্য হয়ে কাজ করবেন- সেটিও বলা হয়নি।
স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের কাজ এখনো দৃশ্যমান নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের হয়তো সদিচ্ছা আছে; কিন্তু ঠিকভাবে কাজ শুরুর জন্য আমলাদের যে সহযোগিতা দরকার, সেটি মিলছে না। আমলারা সেই কাজটিকে সঠিকভাবে এগুতে দিচ্ছে না। তাই-ই যদি না হবে তাহলে কাজ এগুবে না কেন? পুষ্টিবিদ, নার্সসহ স্বাস্থ্য খাতে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তাদের প্রতিনিধি কমিশনে রাখার পরামর্শ দেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ।
এদিকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দুইজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে জানান, সংস্কারের কাজ দৃশ্যমান নয়। তবে প্যানেল থেকে যা করণীয় তা তারা করছেন। কমিশন গঠন করার পর প্যানেলের সদস্যদের ‘স্ট্যাটাস’ কী- এ নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন প্যানেল সদস্যরা। প্যানেলের কাজ সংস্কারের জন্য কী কী করা দরকার- সেই বিষয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে পরামর্শ দেয়া। উপদেষ্টা তাদের পরামর্শ নিতে পারেন নাও নিতে পারেন। তবে তারা তাদের কাজটি করে যাচ্ছেন। আর কমিশন উচ্চ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলবে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও কমিশন একীভূত হয়ে কাজ করবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা জানান, এমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কমিশনের সদস্য হবে আলাদা। কারণ কমিশন প্রধান এবং এর সদস্যরা পূর্ণকালীন হিসেবে কমিশনে কাজ করবেন। গেজেট পাস হলে কমিশন কাজ শুরু করবে। আগেও যে কমিশনগুলো হয়েছে সেগুলোর গেজেট পাস হতেও অনেক সময় লেগেছে। প্রশাসনিক কাজে সময় লাগে। তাছাড়া প্রশাসনের অসহযোগিতাও আছে। আগামী ৬ নভেম্বর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিশেষজ্ঞদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা হওয়ার কথা। সেখানে সংস্কার কাজের প্রতিটি বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা কী তা জানানো হবে।
সংস্কার কাজ কীভাবে শুরু করতে চান এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, গেজেট পাসের বিষয়ে কিছু জানি না। সরকারিভাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর কাজ শুরু করব। তার আগে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। যে দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে তা যেন আমি সঠিকভাবে পালন করতে পারি। আমি সবার সহযোগিতা ও দোয়া চাই।