বিদ্যুৎ সংকট আরো প্রকট

দেব দুলাল মিত্র
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ফলে দেশে বিদ্যুৎ সংকট দিন দিন বেড়েই চলছে। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত একটানা বিদ্যুৎ থাকছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিদ্যুতের অভাবে বিভিন্ন জেলায় ইপিজেডে অনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কম। আক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল। ফলে বিদ্যুৎ সংকটে দেশের মানুষকে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে। কিন্তু শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসছে। ফলে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমলেও সংকট পুরোপুরি কাটেনি। বরং অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ৬২০ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামের এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এখন উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। একই অবস্থা দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের। ৪৪৪ মেগাওয়ার্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৩৫ মেগাওয়াট।
অপরদিকে গত ৩০ অক্টোম্বর থেকে কয়লা সংকটের কারণে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুইটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর কয়লার ওপর নির্ভরশীল। ডিসেম্বরের আগে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় উৎপাদনে আসতে পারবে না।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন) মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন মজুমদার জানান, কিছু মেন্টেইনেন্সের কাজ চলছে। এছাড়া কয়লার সংকট চলছে। এই দুই কারণে গত বৃহস্পতিবার থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুইটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সংকট কাটাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আবার কবে উৎপাদনে ফিরবে তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারছে না। উল্লেখিত ৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার ৯৯ মোগাওয়াট কিন্তু এখন পাওয়া যাচ্ছে ৩ হাজার ১৯৯ মোগাওয়াট। ভারতের আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ যে কোনো সময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন সংকট আরো বাড়বে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, এখন দিনের বেলায় ১১ হাজার এবং রাতের বেলায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় সবাইকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কখনো ১ হাজার, আবার কখনো ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এ কারণেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে কয়লা ও এলপি গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। গ্যাস ও কয়লা সংকটের বড় প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। ফার্নেসঅয়েল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আগে থেকেই বসে আছে। পিডিবির পক্ষ থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়াতে চেষ্টা চলছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, টন প্রতি কয়লা আমদানি ব্যয় কম-বেশি ১০০ ডলার হলেও পিডিবি সেখানকার কয়লা কেনে ১৮৫ ডলারে। এ কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত কয়লা সরবরাহ করতে না পারায় একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বছরে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তার থেকে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমাতে হবে। দেশের চল্লিশটা বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেসওয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে না; অথচ এসব প্রতিষ্ঠান ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, সমতা, যৌক্তিকতা ও জবাবদিহিতা তথা জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও বিদ্যুৎ খাত পরিকল্পনার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। দেশীয় গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমদানি করা গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমিয়ে সাগরে গ্যাস উত্তোলনে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা রাজিব রহমান জানান, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আগের দিন মঙ্গলবার রাতেও কয়েক দফায় লোডশেডিং হয়েছে। প্রায়ই এভাবে লোডশেডিং হচ্ছে এবং এতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রাজধানীর হাজাররীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, মতুয়াইল, শনিরআখড়া, উত্তরখান, দক্ষিণখান, গোপীবাগ এলাকায়ও প্রায়ই লোডশেডিং হচ্ছে।