সিন্ডিকেটের দাবির জেরে ৭শ কোটি টাকা বাড়ল বাজেট

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
বিনামূল্যের পাঠ্যবই গত বছরও ছাপানোর খরচ ছিল প্রায় ১২শ কোটি টাকা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাপাখানা মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আরো ৭শ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৯শ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে ২০২৩ সালের শেষে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার কপি নতুন বই ছাপানো হয়েছিল। আগামী বছরের জন্য প্রায় ৪০ কোটি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এবার গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার সব বই দেশেই ছাপানো হচ্ছে। তবে দশম শ্রেণির এক কোটি পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেবে সেনাবাহিনী।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, ছাপাখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে সরকারের এই বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। অপরদিকে ছাপাখানার মালিকরা বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবার বেশি সংখ্যায় পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়া, পাঠ্যবইয়ে উজ্জ্বলতার পরিমাণ ২ থেকে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া, যে কাজ ছয় মাসের মধ্যে করা হয়, সেটি এখন দুই মাসের মধ্যে করার বাধ্যবাধকতার কারণে শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়া, বছর শেষে পাঠ্যবই ছাপাসহ ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ একসঙ্গে হওয়ায় কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ৭শ কোটি টাকা বেশি খরচ হচ্ছে।
জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ায় প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কপি বেশি বই আগামী বছর ছাপতে হবে। এছাড়া দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমবারের মতো নতুন বই ছাপানোর জন্যও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বই ছাপার খরচ প্রথমে নির্ধারিত ছিল ১২০০ কোটি টাকা। তবে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণে খরচ বাড়াতে হচ্ছে। প্রকাশকরা ‘সিন্ডিকেট’ করে বই ছাপানোর খরচ বাড়িয়ে দরপত্র জমা দেয়ার কারণেও ব্যয় বেড়েছে বলে অভিযোগ এনসিটিবি চেয়ারম্যানের।
তবে প্রকাশকদের ‘সিন্ডিকেট করে ফর্মাপ্রতি খরচ বাড়িয়ে দেয়ার’ অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সহসভাপতি জুনায়েদ আল মাহফুজ বলেন, সিন্ডিকেটের গল্পটি ঠিক নয়। বই ছাপার খরচ বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার বইয়ের সংখ্যা বেশি থাকায় খরচও বেড়েছে। পাশাপাশি গত বছর বইয়ের উজ্জ্বলতা ছিল ৮০ শতাংশ। এবার তা বাড়িয়ে প্রাথমিকে ৮৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৮২ শতাংশ করার ফলেও খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর পাঠ্যবই ছাপা হতো জুন মাস থেকে। এবার মাত্র কদিন আগে বই ছাপা শুরু হয়েছে। একসঙ্গে এত বই এত কম সময়ের মধ্যে ছাপিয়ে দিতে গিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় বই ছাপানোর খরচও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর তাদের রেখে যাওয়া পাঠ্যবইও পরিবর্তন হয়। তখন ২০১২ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবার বড় পরিবর্তনের পথ ধরে ১৪ বছর আগের পাঠ্যসূচিতে ফিরছে প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষা ব্যবস্থা; যে কারণে নতুন বছরে ছাপা মোট বইয়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি ১৬ লাখ, বাড়ছে ছাপার বাজেটও। নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে বেশিসংখ্যক বই থাকার বিষয়কে সামনে এনেছে জাতীয় শিক্ষা বোর্ড ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে বই ছাপায় বেশি টাকা খরচ হলেও নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীরা না-ও পেতে পারে। কারণ অন্যান্য বছর নভেম্বর, ডিসেম্বরে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শেষ হলেও এ বছর এই সময়ে মাত্র বই ছাপা শুরু হয়েছে। সে হিসাবে আগামী মার্চের আগে শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই পাবে না বলে অনেকটাই নিশ্চিত।
তবু আগের বছরগুলোর বই উৎসবের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নতুন বছরের প্রথম দিন এবারো শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে চায় এনসিটিবি। তবে নতুন বই পরিমার্জনসহ বিভিন্ন কারণে বই ছাপা শুরু করতে দেরি হয়েছে। এখনো অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়ে প্রকাশনা কোম্পানির হাতে পৌঁছেনি। এসব কারণে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই যে বছরের শুরুতে বই পাবেন তা মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এনটিসিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৪১টি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ পেয়েছে। চতুর্থ থেকে বাকি শ্রেণিগুলোর বই ছাপার কাজ কারা করবে সেই দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। নবম শ্রেণির বইয়ের কাজ দেয়ার দরপত্রও চূড়ান্ত হয়নি। একইসঙ্গে সেনাবাহিনী দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক কোটি কপি বই ছাপানোর কাজ করবে।
সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় তাদের এ কাজ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান। তিনি বলেন, বিভাগ-বিভাজন উঠিয়ে গত বছর নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে। আর বিভাগ-বিভাজন ফিরে আসবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে। তাই দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন করে ৬ কোটি ৬৪ লাখ কপি বই ছাপানো হচ্ছে। তিনি বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো প্রকাশকরা ফর্মাপ্রতি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ বেশি ধরে টেন্ডার জমা দিয়েছেন। তারা সিন্ডিকেট করে এমনটি করায় খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে। যদিও গত বছরগুলোতে অনেকে ৫৩ শতাংশ কম খরচ ধরেও টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন।
এনসিটিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, সময় কম থাকায় ছাপাখানা মালিকদের দাবিমতো টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাচ্ছে সরকার। এজন্য যেসব শর্ত মেনে ছাপাখানা মালিকরা কাজ পেয়েছেন তাদের প্রতিষ্ঠানে এবার ‘পরিদর্শন’ও জোরদার করা হবে। নির্ধারিত শর্তের বাইরে ছাপানো বই এবার এনসিটিবি গ্রহণ করবে না। শর্ত অনুযায়ী ঠিকঠাক ছাপা হওয়া বই এনসিটিবি গ্রহণ করবে। শর্তের বাইরে বই পেলেই জরিমানাসহ কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এরইমধ্যে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ভাই রাব্বানী জব্বারের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান আনন্দ পাবলিশার্স শাস্তির আওতায় এসেছে।