×

প্রথম পাতা

পাঁচ পণ্যে সিন্ডিকেটের থাবা

Icon

মরিয়ম সেঁজুতি

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাঁচ পণ্যে সিন্ডিকেটের থাবা
   

শীতকালীন সবজি ছাড়া বাজারে সব কিছুরই দাম রীতিমতো আকাশচুম্বি। ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বেড়েছে মূল্যস্ফীতিও। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও সেভাবে বাড়ছে না আয়; ফলে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। এদিকে বরাবরের মতো এবারো রমজানের ছয় পণ্যের ওপর নজর পড়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের। কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে- অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর, পেঁয়াজ প্রভৃতি পণ্যের দাম বাড়ানো শুরু করে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধে অতীতে কর্তৃপক্ষ নানা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তাতে কোনো সুফল মেলেনি। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে বাজার তদারকি জোরদার করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, গত ৩১ অক্টোবর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার অনুমোদন দেয়া হয়। আসছে রমজান মাসে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ঘাটতি যেন না হয় সেজন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। এ ঘাতক কতটা নির্মম হতে পারে, নিম্ন আয়ের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পান। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি- কারণ নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যয়ের বড় অংশ চলে যায় খাদ্যের পেছনে।

গত কয়েক অর্থবছর ধরেই মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল বাজেটে। তবে বাস্তবতার আলোকে সে লক্ষ্যমাত্রায় সংশোধন আনা হচ্ছে। গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের দর স্থিতিশীল থাকা, কিছু খাদ্যপণ্যে শুল্ক কমানো, আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়ার পরও বাজারে অস্থিরতা রয়েই গেছে। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজান আসতে আরো প্রায় তিন মাসের মতো বাকি। এর মধ্যে বাজারে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন পাঁচ পণ্য- চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুরের উত্তাপ বাড়ছে। রমজানের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে সরকার সন্তোষ প্রকাশ করলেও আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বরাবরের মতো এবারো অসাধু ব্যবসায়ীদের অপকর্মে অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে বাজার। দুশ্চিন্তা বাড়ছে সাধারণ মানুষের।

এদিকে রমজানে চাহিদা বাড়ে এমন ১১টি নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে শুল্ক ছাড় দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণপত্র খোলায় শিথিলতা দেখিয়েছে। পণ্যগুলো হচ্ছে- চাল, গম, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা এবং খেজুর। এসব পণ্য আমদানিতে এখন থেকে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে নগদ মার্জিন রাখতে হবে। এ নির্দেশনা আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে। আমদানিকারকরা বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক থাকার কথা জানালেও ভরসা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ব্যবসায়ীরা কত দামে পণ্য আনেন, সেই বিষয়ে দেশে কোনো তদারকি নেই। ফলে তারা ইচ্ছেমতো যেকোনো পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও তাই। সামনে রমজান মাস। তাই এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান বাদশা বলেন, সাধারণত রমজান শুরু হওয়ার চার-পাঁচ মাস আগে থেকে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকগুলোর নানান সমস্যার কারণে এখনো প্রত্যাশিত এলসি খুলতে পারছেন না তারা। রমজানের আগে অন্যবার যে পরিমাণ ছোলা আমদানি হয়েছিল; এবার তেমনটি আসেনি। এজন্যই বাজারে কিছুটা দাম বেড়েছে।

এদিকে, রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের স্বস্তি থাকবে কিনা- জানতে চাইলে গত বুধবার ৪ ডিসেম্বর সরকারি ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্বস্তিদায়ক হবে, খেজুর আমদানির জন্য ইতোমধ্যেই এলসি খোলা হয়েছে এবং আসবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়- এমন ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই।নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমেছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সয়াবিন তেলের দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় এবং কীভাবে আরো আমদানি করা যায় সে বিষয়েও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসের ওপর শুল্ক কমিয়েছি। সুতরাং আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

কারসাজিতে উধাও ভোজ্যতেল : রোজা যত ঘনিয়ে আসছে, ভোজ্যতেলের বাজারে অসাধু চক্রের কারসাজি ততই বাড়ছে। রোজা শুরুর তিন মাস আগেই কোম্পানিগুলো মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ কারণে বাড়তি দামেও চাহিদামতো তেল পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। বাজার থেকে একরকম উধাও হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় এ পণ্যটি। মাসের ব্যবধানে লিটারে ২০ টাকা বেড়ে খোলা সয়াবিন তেল খুচরা বাজারে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাদের আশঙ্কা, প্রতি বছরের মতো এবারো রমজানে বাড়তি দরেই কিনতে হবে ভোজ্যতেল।

নিরবে বাড়ছে ছোলার দাম : এক প্রকার নিরবে বাড়ছে ছোলার দাম। গত কয়েক বছরও এমন চিত্রই দেখা গেছে। এবারো বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি শুরু হয়ে গেছে। বাড়ানো হয়েছে ছোলার দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে পণ্যটি ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারের আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রোজার তিন মাস আগেই গত বছরের তুলনায় ছোলার দাম ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়েছে।

অনেক বেড়ে সামান্য কমেছে চিনির দাম : চিনি আমদানিতে শুল্ক-কর কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাতে প্রতি কেজি চিনিতে কম বেশি ১১ টাকা শুল্ক-কর কমেছে। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে দেশের বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়বে এবং পণ্যটির দাম কমে আসবে। কিন্তু উল্টো পণ্যটির দাম বেড়েছে। তবে গত দুদিনে বাজারে সরবরাহ বাড়তে থাকায় কিছুটা কমেছে দাম। খুচরা পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্রতি কেজি চিনিতে কমবেশি ১১ টাকা শুল্ক-কর কমিয়েছে। তাতে এখন চিনির দাম কমে প্রতি কেজি ১০০-১১৫ টাকা হওয়ার কথা ছিল।

ভরা মৌসুমেও বাড়তি পেঁয়াজের দাম : মৌসুমের শেষ দিকে এসে আবার বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দাম। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৩০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল তা ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয় ১৪০ টাকা দরে। অপরদিকে গত সপ্তাহে ক্রস জাতের পেঁয়াজ ছোট ও বড় আলাদা করে প্রতি কেজি যথাক্রমে ১২০ ও ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা করে। আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৯০-১০০ কেজিতে বিক্রি হলেও তা গতকাল ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়া নিয়ে বিক্রেতা মো. ইউসুফ বলেন, দেশি পেঁয়াজে এখন গাছ হয়ে যাচ্ছে। আবার শুকিয়েও যাচ্ছে। অনেক নষ্ট বের হয়। দোকানে এনে বেশি দিন রাখা যায় না। আমাদের অনেক পেঁয়াজ ফেলে দিতে হয়। তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। পেঁয়াজ কিনতে আসা জয়নাল আবেদীন বলেন, বাজার আর সরকার কন্ট্রোল করতে পারবে বলে মনে হয় না। যে যেভাবে পারছে ব্যবসা করছে। কয়েক দিন মনিটরিং করে আবার থেমে যায়। নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। তার প্রশ্ন, পেঁয়াজ কেন এখনো আমাদের ১৪০ টাকায় কিনে খেতে হবে?

খেজুরের দামেও স্বস্তি নেই : সারা বছরই চলে খেজুরের বেচাকেনা। তবে রমজান মাসে এর চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই মাসে চাহিদা থাকে সারা বছরের চাহিদার প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। সে কারণে রমজানে খেজুরের দাম বেড়ে যায়। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সাধারণত প্রতি বছরই শুল্ক ছাড় দিলেও তা সময়োপযোগী হয় না। এতে প্রভাব পড়ে না বাজারে। এবার অবশ্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রস্তাব আমলে নিয়ে রমজানের বেশ আগেই শুল্ককর ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি রোজার ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ এই পণ্যটির অগ্রিম কর পুরোপুরি তুলে নেয়া হয়েছে। এতে খুচরা বাজারে খেজুরের দাম কমবে বলে মনে করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে বর্তমানে বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি খেজুরের দাম ৪৮০ থেকে শুরু করে এক হাজার ৭০০ টাকা।

সরজমিন দেখা গেছে, প্রতি কেজি আম্বার খেজুরের গড় দাম এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা, মরিয়ম খেজুরের দাম এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, আজওয়া খেজুরের দাম এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। বাজারে সাধারণ মানের খেজুরের মধ্যে প্রতি কেজি নাগা খেজুর ৪৮০ থেকে ৫৪০ টাকা, জেহাদি ও খুরমা খেজুরের দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেজুরের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, পাঁচ বছর আগে প্রতি কেজি জেহাদি খেজুর বিক্রি হতো ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। বর্তমানে এই খেজুরের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। সে হিসাবে এই খেজুরের দাম বেড়েছে আট গুণেরও বেশি।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App