মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখেই দেশ গড়ার প্রত্যয়

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
উদ্যত খড়গের ভয় উপেক্ষা করে, শানিত অস্ত্রে শত্রুকে রুখে দিয়ে ৫৩ বছর আগে রক্তের আকড়ে কেনা হয়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলা, বাঙালির ঠিকানা। দহনকাল পেরিয়ে একাত্তর কেবল বিশেষ একটি সংখ্যা নয়- বাঙালির আস্থা, হৃদয়ের চেতনা; মুক্তির, স্বাধীনতার, বিজয়ের। ৫৩ বছর আগে এসেছিল চূড়ান্ত বিজয়। গতকাল সোমবার বাঙালির দুয়ারে ফিরে এসেছিল গৌরবের পতাকা হাতে সেই দিন। বিজয় দিবসের ঊষালগ্নে আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সব পথ এক হয়ে মিশে গিয়েছিল ঢাকার অদূরে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। আর বাঙালির তীর্থস্থান উন্মুক্ত হয়ে যেন খুলে গেছে সহস্র বছরের দ্বার। সূর্যসন্তানদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে নামে জনতার ঢল। স্মৃতিসৌধ, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে উৎসবের আবহে উদযাপন করা হয় মহান বিজয় দিবস। একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি শপথ নেয় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার। শপথ নেয় একাত্তরে পরাজিত অপশক্তির সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের।
বাংলাদেশের ৫৪তম বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর উপকণ্ঠে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিনি। এ সময় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ (এএফডি) বাংলাদশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালর মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। রাষ্ট্রপতি
সাহাবুদ্দিন জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এর আগে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছলে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে তিন বাহিনীর প্রধান স্বাগত জানান। এ সময় আহত বীর মুক্তিযাদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদষ্টা, বিদেশি কূটনীতিক, আমন্ত্রিত অতিথি এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বীর মুক্তিযাদ্ধা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহত মুক্তিযাদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শুভেছা বিনিময় করেন।
এরপর সকাল ৭টা ১২ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মণ্ডলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধান উপদেষ্টা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস দল প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে রাখা দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন।
বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। গতকাল সকাল সোয়া ৭টায় তিনি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বলে সুপ্রিম কোর্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, পুষ্পস্তবক অর্পণের পর প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টার পর প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা একসঙ্গে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
ফুলে ফুলে বরে ওঠে স্মৃতিসৌধ : ভোরে রাষ্ট্রপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধ খুলে দেয়া হয় সর্ব সাধারণের জন্য। এরপর সেখানে নামে হাজারো মানুষের ঢল। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সি মানুষের পদচারণায়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল ছিল বেলা ১টা পর্যন্ত। এরপর ধীরে ধীরে ভিড় কমতে থাকে। বিশালাকারের জাতীয় পতাকার ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষ। বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতারা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাকর্মীরা। স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় জাতীয় নাগরিক কমিটি। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। মহান বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর ও বয়োবৃদ্ধরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান বীর শহীদদের। স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা রফিকুল ইসলাম নামে একজন বলেন, আমরা মিরপুর থেকে পরিবার নিয়ে এসেছি; যাদের জীবনের বিনিময়ে দেশে স্বাধীনতা পেয়েছি- তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। মীম আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন হতে দেখিনি। তবে যারা দেশকে স্বাধীন করেছেন তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা জেনেছি। আমরা নতুন প্রজন্ম তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। গাজীপুর থেকে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন রওশন হারুন নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার শপথ নিয়েছি। শুধু আমি নই; আমার মতো যারাই এখানে এসেছেন- সবাই একই শপথ নিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসম্বর, ত্রিশ লাখ শহীদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয় এবং বাংলাদশ স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম লাভ করে। ১৯৭১ সালর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে স্মরণ করতে প্রতি বছর ১৬ ডিসম্বর বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে দিনটি উদযাপন করে।