সড়কের খানাখন্দে জনদুর্ভোগ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ সড়কই এখন ভাঙাচোরা। একদিকে খানাখন্দ অন্যদিকে এবড়ো-থেবড়ো। বেশ কিছু এলাকায় সড়কের অবস্থা একেবারেই বেহাল। কোনো কোনো এলাকায় ফুটপাতের অবস্থাও খারাপ। তার পর অসংখ্য ম্যানহোলে নেই কোনো ঢাকনা। আর বিভিন্ন স্থানে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি তো চলছেই। যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। আহত হচ্ছেন পথচারীদেরও কেউ কেউ। এই চিত্র এখন রাজধানীর অলিগলি থেকে মূল সড়কের। তারপর আছে ঢাকার যানজট। মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুন। দায়িত্বশীলরা এই অবস্থার কথা স্বীকার করে ছোট ছোট খানাখন্দ দ্রুত মেরামতের আশ্বাস দিলেও তারা বলছেন ভাঙাচোরা সড়কগুলো পুরোপুরি মেরামত করতে সময় লাগবে আরো ৬ মাস। নগরবাসীর মতে, জনপ্রতিনিধি থাকায় আগে এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান হলেও, এখন কষ্টের কথা বলার তেমন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে সড়ক সংস্কারসহ অন্যান্য সেবা পেতেও হিমসিম পোহাতে হচ্ছে তাদের।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ছোট-বড় মিলে মোট সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার। আর ফুটপাত আছে ২৩১ কিলোমিটার। সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বর্ষায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১৪ কিলোমিটার। আর ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৭ কিলোমিটার। অপরদিকে নতুন ১৮টি ওয়ার্ড ব্যতিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় মোট সড়ক রয়েছে ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার। আর ফুটপাত রয়েছে ৩০০ কিলোমিটার। এসব সড়কের মধ্যে কি পরিমাণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য নেই ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগে। তবে
সংস্থাটির কারো কারো মতে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫০ কিলোমিটারের মতো সড়ক। যদিও সংস্থাটির দাবি, রুটিন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোতে মেরামত কাজ চলমান রয়েছে।
ডিএসসিসির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা আইডিয়াল স্কুলের মাঝামাঝি সড়কটির অবস্থা খুবই খারাপ। সামান্য বৃষ্টি হলেই এই সড়কটি হাঁটু পানিতে ডুবে থাকে আর ভারি বৃষ্টি হলে তো কোনো কথায়ই নেই। কোমর পরিমাণ এমনকি বুক পরিমাণ পানি জমে থাকে এখানে। শুক্রবার সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, সড়কটির পিচ ঢালাই উঠে গেছে। পুরো সড়কজুড়ে ভাঙাচোরা আর এবড়ো-থেবড়ো। উধাও হয়ে গেছে ম্যানহোলের ঢাকনাও। অথচ এই সড়কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজন এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বাসাবো, মুগদাসহ ওই অঞ্চলের কয়েকলাখ মানুষ প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলাচল করেন সড়কটি দিয়ে। ভোগান্তিতে বিরক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কয়েক বছর যাবত এই সড়কের একই হাল। মনে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের এটি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সবচেয়ে দুরবস্থা হলো- এই সড়কের পশ্চিমপ্রান্তে একই জায়গায় রয়েছে মুগদা কবরস্থান, মুগদা মেডিকেল আর মুগদা আইডিয়াল স্কুল। আর সেই জায়গাতেই বর্ষায় কোমর পানি, শুকনো মৌসুমে খানাখন্দে ভরা- দিনের পর দিন এভাবেই দেখে আসছি। জানি না, এই সমস্যার সমাধান কবে হবে? আমরা দাবি করছি, অতিদ্রুত এই রাস্তাটি যথাযথভাবে স্থায়ী মেরামত করা হোক।
এক বছরের বেশি সময় ধরে মুগদা-মান্ডা সড়কটিও কেটে রাখা হয়েছে উন্নয়ন কাজের জন্য। কোনো যানবাহন চলাচল করছে না। বলা যায়, কাজ এখন বন্ধ আছে। কয়েক লাখ মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফলে রিকশা ও অটোরিকশাসহ মোটরসাইকেল চলছে আশপাশের অলি-গলি দিয়ে। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে মতিঝিল ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলেও আশপাশের সড়ক ও অলিগলি ভাঙাচোরা এবং গর্তে ভরা। কমলাপুর স্টেশন থেকে আরামবাগ সড়কটির একটি অংশ একেবারেই ভাঙাচোরা। বাসসহ যানবাহন চলছে হেলেদুলে। নটরডেম কলেজের সামনের থেকে মতিঝিল শাপলাচত্বর হয়ে মধুমিতা সিনেমা হলের সামনের সড়কটি আংশিক মেরামত করা হলেও এখনো ঢালাই করা হয়নি। ফলে মাটি বসে গিয়ে ছোট ছোট গর্তের তৈরি হয়েছে। টিকাটুলির মূলসড়কেও দেখা গেছে বড় বড় গর্ত। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়কে বড় বড় গর্ত করে কাজ ফেলে রাখা হয়েছে। কমলাপুর স্টেডিয়ামের উল্টো দিকের সড়কটি- যেটি কমলাপুর ও মতিঝিলের মূল সড়ক। মেট্টোরেল ও আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য সড়কটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। যানবাহন তো দূরের কথা কোনো মানুষই চলাচল করতে পারছে না। সায়েদাবাদ. যাত্রাবাড়ী, মানিকনগর ও গোপীবাগ এলাকার মানুষকে বহুপথ ঘুরে যেতে হয় নিজ নিজ গন্তব্যে। শান্তিনগর মোড় থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে দিয়ে মতিঝিলের আরামবাগ সড়কে যাওয়া-আসার দুই দিকেই এবড়ো-থেবড়ো অবস্থা। বেশকয়েকটি ম্যানহোল ঢাকনাবিহীন। ডিআইটি মোড় থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ভেতরের সড়কেরও অবস্থা খুবই নাজুক।
একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকার বেশির ভাগ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে অনেকদিন ধরেই। আসাদ গেট থেকে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ পর্যন্ত সড়কের কাটা অংশ বসে গিয়ে মূল রাস্তা থেকে নিচু হয়ে গেছে। কাটাসুর, তাজমহল রোড, বাঁশবাড়ী রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড ও নুরজাহান রোডের সংযোগ সড়কগুলোরও একই অবস্থা। এই এলাকার অনেক সড়ক ও অলিগলিতে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।
রাজধানীর মধুবাগ থেকে শুরু করে মীরবাগ মোড়, হাতিরঝিল সড়কটিরও একই দশা। মিরপুর কাজীপাড়া এলাকার প্রতিটি অলি-গলি ভাঙাচোরা। ফুটপাত ভাঙা, ম্যানহোলে নেই ঢাকনা। স্থানীয় বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, শুধু কাজীপাড়া নয়, আশপাশের প্রতিটি অলি-গলির অবস্থা খারাপ। বর্ষার সময় এসব রাস্তার পিচ ঢালাই উঠে গেলেও এখন পর্যন্ত সেগুলো মেরামত করা হয়নি। এছাড়া প্রতিতি সড়ক ও অলি-গলিতে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে গেছে। মাসের পর মাস সেভাবেই পড়ে আছে। মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই।
এদিকে দফায় দফায় প্রতিশ্রæতি দিয়েও কয়েক মাস ধরে ঢাকা দক্ষিণের ভাঙাচোরা সড়কগুলো সচল করতে পারছে না সংস্থাটি। দায়িত্বশীলরা বলছেন, ভাঙাচোরা সড়ক সচল করতে আরো ছয় মাস সময় লাগবে। এই সময়ে মানুষকে ভোগান্তি মেনে নিয়েই চলাচলের অনুরোধ জানান তারা। তবে মানুষের কষ্ট যাতে কম হয় সেদিকেও খেয়াল রাখার কথা বলছেন তারা। গত ১৯ ডিসেম্বর নগর ভবনে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের সার্বিক কার্যক্রম সাংবাদিকদের জানানো হয়। সেখানে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, চলতি বছর অতি বৃষ্টির ফলে রাস্তাঘাটে যে ছোট ছোট খানাখন্দ তৈরি হয়েছে, সেগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যা আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। তারপর বড় বড় রাস্তার কাজগুলো দরপত্র প্রক্রিয়ায় দ্রুত ঠিক করার ব্যবস্থা করা হবে। কারণ অতি বৃষ্টির কারণে এবার আমাদের রাস্তাঘাটগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যদিও এর আগে গত ১৩ অক্টোবর ডিএসসিসির জনসংযোগ শাখা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ওই মাসের মধ্যেই দক্ষিণ সিটির সব সড়কের খানাখন্দ ও গর্ত ভরাটের কাজ শেষ হবে। এরপর নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরও শেষ হচ্ছে। কিন্তু কাজ খুব একটা এগোয়নি। উল্টো মেরামত না করায় বেশির ভাগ সড়কের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ওই সংবাদ সম্মেলনে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন জানান, কিছু রাস্তার অবস্থা আসলেই খারাপ। যেসব সড়কে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো ভরাট করে সড়ক সচল করার চেষ্টা করা হয়েছিল; কিন্তু তা কাজে দেয়নি। তাই কয়েকটি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সচল করতে ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। কাজ শুরুর পর সর্বোচ্চ ছয় মাস সময় লাগবে। সে পর্যন্ত জনভোগান্তি থাকবে। তবে মানুষের ভোগান্তি যতটা কমানো যায়, সেই চেষ্টা থাকবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন ১৮টি ওয়ার্ড বাদে ডিএনসিসি এলাকায় ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এছাড়া ড্রেনেজ আছে ১ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার আর ফুটপাত আছে ৩০০ কিলোমিটার। যখন যেখানে দরকার হয়, তখন সেখানে ভাঙাচোরা সড়ক ও ফুটপাত দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। বর্তমানে কি পরিমাণ সড়ক ও ফুটপাত ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ডিএনসিসির প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসে এর তথ্য আছে। তারা সেভাবেই কাজ করছেন। নগরবাসীকে দ্রুত সেবা দিতে ডিএনসিসির বর্তমান প্রশাসন খুবই তৎপর রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।