প্রতিটি নিঃশ্বাসেই জীবাণু

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
নিত্য নতুন সামনে আসছে বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণ। এছাড়া পুরাতন ভাইরাসগুলোও আবার সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঘটনাগুলো নিত্যনতুন ভাইরাস কিংবা পুরনো ভাইরাসের নতুন রূপে ফিরে আসতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এই ভাইরাসগুলো নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে সংক্রমণ বাড়ায়। বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ; যেমন- ইনফুয়েঞ্জা এবং এই ভাইরাসের সমগোত্রীয় ভাইরাস, সার্স, মার্স, কোভিড-১৯, হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস (এইচএমপিভি), রিও, ডিপথেরিয়া ছাড়া যক্ষ্মা, ব্যাক্টেরিয়া, হামের ভাইরাসও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে। তবে মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই এসব সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সম্প্রতি হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাসের (এইচএমপিভি) সংক্রমণ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, দেশে একজন নারীর শরীরে এইচএমপি ভাইরাস পাওয়া গেছে। ভৈরবের বাসিন্দা এই নারীর বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে তিনি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত। যার মধ্যে ভাইরাস হচ্ছে এইচএমপিভি ও ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়ার ব্যাকটেরিয়ায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তবে এইচএমপিভির কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নন।
এইচএমপিভি সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এর মধ্যে দেশের সব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিভিল সার্জন, জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বিমানবন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৮ জানুয়ারির সেই নির্দেশনায় বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিস্থিতির উপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে। এইচএমপিভি অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগের মতো ফ্লুর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করে। যা সাধারণত ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তাই আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নাই। সবাইকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এমন নির্দেশনা পেয়ে এইচএমপি ভাইরাস প্রতিরোধে বেনাপোল ইমিগ্রেশনে সতর্কতা জারি হয়েছে।
আরো পড়ুন: এইচএমপিভি নিয়ে বিমানবন্দর ও এয়ারলাইন্সগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা
নতুন নতুন ভাইরাস সামনে আসা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের কারণে নিত্য নতুন ভাইরাস, সংক্রামক ব্যাধি আমাদের সামনে আসবে। প্রকৃতিকে যেভাবে উজাড় করে দিচ্ছি, জীব-জন্তু লোকালয়ে চলে আসছে। এসব প্রাণী থেকে বিভিন্ন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টিও বাড়বে।
তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান- এইচএমপি ভাইরাস আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এটি আগেও ছিল। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এইচএমপিভি কোভিডের মতো নতুন কোনো ভাইরাস নয়। শ্বাসতন্ত্র জনিত ভাইরাস যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটাতে পারে। যদি কোনো আউটব্রেক হয়; তাহলে মাস্ক পড়া, সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, সতর্ক থাকা জরুরি।
তথ্য অনুযায়ী, এইচএমপিভি একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা ওপরের এবং নিচের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটায়। এটি সব বয়সের ব্যক্তিদের প্রভাবিত করে। তবে শিশু, বয়স্ক এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য ভাইরাসটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এই ভাইরাসের উপসর্গগুলো ফ্লু এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতোই। সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট। গুরুতর ক্ষেত্রে, ভাইরাস ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
আরো পড়ুন: এইচএমপিভি কি, কীভাবে ছড়ায়? লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করণীয়
জনস্বাস্থ্যবিদ ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে ২০০০ থেকে ২০০১ সালে প্রথম এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত হয়। আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ডব্লিউ এ ব্রুক্সের নেতৃত্বে ইউএসএ-র ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে আইসিডিডিআরবি-র সহযোগিতায় ঢাকার কমলাপুরে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে ১৩ বছরের কম শ্বাসতন্ত্রীয় রোগীর দেহে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এইচএমপিভি ভাইরাস পাওয়া যায়। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি গবেষণায়ও এই ভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছে অনেকের দেহে। আমাদের প্রতিবেশ, পরিবেশ, জীবন যাত্রার সঙ্গে অভ্যস্ত আমরা। যেহেতু পরীক্ষা করা হয় না, তাই রোগী কম পাচ্ছি। পরীক্ষা করা হলে রোগী আরো আগেই আরো বেশি রোগী শনাক্ত হতো। তবে এই ভাইরাস নিয়ে ভয় ও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভারত, চীনসহ কিছু দেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। তবে ওই সব দেশসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভাইরাসের বিষয়ে কোনো রেড এলার্ট বা সতর্ক বার্তা জারি করেনি। আমেরিকাসহ উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে প্রতি বছরই এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী পাওয়া যায়। তিনি আরো বলেন, বায়ুবাহিত ভাইরাসগুলো অর্থাৎ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে আমরা যেসব ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়ায় সংক্রমিত হই- সেগুলো থেকে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সুরক্ষা পেতে পারি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, চীনসহ উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে এইচএমপি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ভাইরাসের তীব্রতা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশু এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা; যেমন- হাপানি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ গর্ভবর্তী মহিলা এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাক্তিদের জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এই রোগের সংক্রমণ দেখা যায়। সম্প্রতি চীন ও অন্যান্য দেশে এর প্রার্দুভাব দেখা দেয়ায় বাংলাদেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। যার জন্য সব স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র এবং দেশে প্রবেশ পথগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করা প্রয়োজন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে অধিদপ্তর থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো- শীতকালীন শ্বাসতন্ত্রের রোগসমূহ হতে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার; হাঁচি/কাশির সময় টিস্যু বা কনুই দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখা; ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনা যুক্ত ময়লা ফেলার ঝুঁড়িতে ফেলা এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা; আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সংস্পন্ন এড়িয়ে চলা এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা; ঘনঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোঁয়া (অন্তত ২০ সেকেন্ড); অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ না ধরা; জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকা এবং প্রয়োজন হলে নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করা।