বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ
দূষণের বিষে ‘নীল’ পরিবেশ

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাদা কিংবা নীলের বদলে আকাশ এখন ধূসর। বিশেষ করে ঢাকায়। ভরা বর্ষায়ও নামে না বৃষ্টি। ফোটে না কমদসহ বর্ষার ফুল। শীতকালে দেখা মিলে না শীতের। সুউচ্চ ভবনের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। গরমের তীব্রতাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। মাটি-পানি-বায়ু দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে চিরচেনা পরিবেশ বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। বদলে যাচ্ছে জলবায়ুও। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে। পৃথিবীব্যাপী এখন দূষণকে দেখা হচ্ছে ‘বিপর্যয়’ হিসেবে।
বৈশ্বিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, শব্দদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এক নম্বরে এবং দেশের আরেক শহর রাজশাহীর অবস্থান চতুর্থ নম্বরে। বায়ুদূষণে প্রায় দিনই বিশ্বের শীর্ষে থাকছে ঢাকা। নদীর পানিদূষণে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে ফেলায় বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। আর পলিথিনের ব্যাগে তো রীতিমতো ছেয়ে গেছে দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্লাস্টিক দূষণ শুধু বাংলাদেশের নয়, উন্নত অনুন্নত সব দেশের অবস্থাই ভয়াবহ। এভাবে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পৃথিবী ও নিজেদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে মানুষ।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ। বেশি ক্ষতি হচ্ছে দরিদ্র, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু, বয়স্ক ও নারী জনগোষ্ঠীর। মারাত্মক দূষণে বছরে অকালমৃত্যু ঘটছে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের। বায়ুদূষণ, অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের স্যানিটেশন ও হাইজিন এবং সিসাদূষণে এই অকালমৃত্যু হচ্ছে। ঘরের ও বাইরের বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলায় ৫৫ শতাংশ অকালমৃত্যু ঘটেছে। দেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখবিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রতি তিন শিশুর একজন বা প্রায় ২ কোটি শিশু প্রতিদিন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের মোট ৯৯ শতাংশ বা ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশু প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হবে। এ সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি। ২০২০ সালে মাত্র ২৬ লাখ শিশু, যা দেশের মোট শিশুর ৫ শতাংশ, এই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের দিক থেকে বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবী খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে আর প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নিয়ে মানব সভ্যতাকে বিলীনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও
বিভিন্ন ধরনের দূষণের কারণে পৃথিবী এখন এমনই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে এখনই জোরালো কার্যক্রম হাতে না নিলে দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের ওপর পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি পড়বে, যা দেশের উন্নয়নের গতিকে আরো দুর্বল করে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ আন্দোলনকারীরা বলছেন, নদনদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ুদূষণ, শিল্প-কারখানার দূষণ, মাত্রাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক উত্তোলনে দেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। দেশ বাঁচাতে সবার আগে পরিবেশ বাঁচাতে হবে।
এ নিয়ে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ করছিলেন তারা। এদিকে দায়িত্ব নেয়ার পর পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর ১০০ দিনের কর্মসূচির মধ্যে বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, পাহাড় কাটা ও জলাধার ভরাট রোধসহ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান। সেই মোতাবেক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। মন্ত্রণায়ের এমন উদ্যোগকে পরিবেশবাদীরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তিও রয়েছে।
বাংলাদেশের পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতা এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলছেন, পরিবেশ দূষণের বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। যেমন- বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যদূষণ, শব্দদূষণ প্রভৃতি। এসব দূষণের কারণে কোনো না কোনোভাবে মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কিছু ক্ষতি প্রত্যক্ষভাবে হচ্ছে। যেমন- কীটনাশক মেশানো লিচু খেয়ে শিশু মারা গেল বা বিষাক্ত মাছ খেয়ে কেউ অসুস্থ হলেন। আবার কিছু ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। যেমন- রাসায়নিক বা কীটনাশক মেশানো বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেলো। বা দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে থেকে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। নিজেরা আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আইনের প্রয়োগ তো করতেই হবে, সেই সঙ্গে বায়ু দূষণ যাতে না হয়, পানি বা শব্দদূষণ না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের সতর্ক হতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, শব্দ ও বায়ূদূষণের কারণে মানুষ শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। কারণ আমরা বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ বা বায়ুদূষণ করছি, যার প্রভাব ফেলছে অন্যজনের স্বাস্থ্যে। বায়ু ও পরিবেশ দূষণ মোকাবিলায় আইনের যথাযথ প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণ রোধ, পরিকল্পিত নগরায়ন ও নদীর পানিদূষণ রোধে জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সংসদীয় ককাস গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী। এছাড়া ২০২৬ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ কমানো; আগামী বছর থেকে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সংক্রান্ত বিষয়সমূহ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা; ঢাকাসহ সারাদেশে ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ ঠেকাতে ৭৩ হাজারের বেশি বাস-ট্রাক প্রত্যাহার; অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে ইটভাটা ম্যাপিং এবং দূষণ বের করে ব্যবস্থা নেয়া এবং ড্রোনের মাধ্যমে নদীদূষণ বের করা; সার্বিকভাবে বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কৌশলগত পরিকল্পনা নেয়ার মতো মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগগুলো পরিবেশবাদীরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। এখন গঠনমূলক কর্মপরিকল্পনা দরকার। সেদিক থেকে যে উদ্যোগগুলো নেয়ার কথা বলা হচ্ছে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক প্রাণঘাতী। আমরা দীর্ঘদিন থেকে এটা নিয়ে কথা বলছি। কখনো বিষয়টিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে আগামীতে অবশ্যই ভালো কিছু হবে। উন্নয়ন আর পরিবেশ রক্ষা পাশাপাশি চলতে পারে না বলে কেউ কেউ মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, পরিবেশ ব্যক্তি ও জনস্বাস্থ্যেরও বিষয়। সংবিধান অনুযায়ী সব উন্নয়ন হতে হবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় মাথায় রেখে। জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির নেতৃত্বে ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। আর ‘বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ, সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা অনুষ্ঠিত হবে। পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পরিবেশ মেলা ও বৃক্ষমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী এদিন পলাশ ও বেল গাছের দুটি চারা রোপণের মাধ্যমে জাতীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। পরিবেশ মেলা চলবে ৫ জুন থেকে ১১ জুন পর্যন্ত এবং বৃক্ষমেলা চলবে ৫ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন মেলা চলবে সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ২০২৩ ও ২০২৪, জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৩, বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার ২০২২ ও ২০২৩ এবং সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের মাঝে লভ্যাংশের চেক বিতরণ করা হবে। পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে শিশু চিত্রাঙ্কন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিতর্ক ও স্লোগান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বৃক্ষমেলার আয়োজনে করা হবে। এ উপলক্ষে শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষের চারা বিতরণ করা হবে।