বিজিএমইএ
অস্থিরতায় পোশাক শিল্পের ক্ষতি ৪০ কোটি ডলার

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

৫ আগস্টের পর গত দুই মাসের শ্রমিক অসন্তোষে উৎপাদন খাতে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। শ্রমিক অসন্তোষে যেসব ক্রেতা অন্য দেশে চলে গেছে তারাও দ্রুত ফের বাংলাদেশি কারখানায় ক্রয়াদেশ দেবেন বলে আশা করছেন সংগঠনটির সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। পোশাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিককে ন্যায্য মূল্যে টিসিবি পণ্য বিক্রয় কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া শিল্পে বিদ্যুতের যৌক্তিক দাম নির্ধারণসহ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহিল রাকিব, ভাইস প্রেসিডেন্ট (ফাইন্যান্স) নাসির উদ্দিন, ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক শোভন ইসলাম, শামস মাহমুদ, আবরার হোসেন সায়েম, ব্যারিস্টার শেহরিন সালাম ঐশী, মহিউদ্দিন রুবেল, সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী সাগর, রেজাউল আলম মীরু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত দুই মাসে শ্রম অস্থিরতার কারণে শিল্পকে বড় মাশুল দিতে হয়েছে। এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধে যারা শিল্প ও অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বিজিএমইএ।
খন্দকার রফিকুল বলেন, দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে এই খাত। শ্রমিক অসন্তোষ থেকে সদ্য নিরসন পাওয়া পোশাক খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটি নিরূপণ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে আমাদের কাছে আসা প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা আরো বাড়তে পারে। রপ্তানিতে প্রায় ৮৬ শতাংশ অবদান রাখা এ শিল্প শঙ্কামুক্ত হলেও এ সময়ে হারাতে হয়েছে ক্রয়াদেশ। এতে ক্ষুণ্ন হয়েছে এই শিল্পের ভাবমূর্তি। সার্বিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে ও শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের কাছে ১৩ দফা সহযোগিতা চেয়েছেন মালিকরা।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, শ্রম অসন্তোষে আশুলিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯টি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সেপ্টেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের সক্ষমতা ছিল না। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সেপ্টেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের লক্ষ্যে ৩৯টি পোশাক কারখানাকে সুদবিহীন সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের শিল্প ভালো নেই। বিশ্বে পোশাক আমদানি কমে আসছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি পরিমাণের দিক থেকে বেড়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ থেকে কমে গেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। চীন থেকে বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। একইভাবে ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
ইউরোপে জানুয়ারি-জুলাই সময়ে মোট আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং পাকিস্তান থেকে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।
আর তুলনামূলক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির বিচারে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। যেটি এসব দেশে রপ্তানি আদেশ চলে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের কথা বলে পোশাক শিল্পের নগদ সহায়তার হার কমিয়ে আনা হয়েছে। এটি শিল্পে অনাকাক্সিক্ষত ঝুঁকি ও বিপর্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর অনেক মধ্যম আয়ের দেশ তাদের শিল্পের জন্য নামে-বেনামে প্রণোদনা দিয়ে আসছে। যার অনেক উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। অতএব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পোশাক খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রণোদনা পুনর্বহালের বিষয়টি বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে অনেক উদ্যোক্তা বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে ব্যবসায় টিকতে পারছেন না। বিজিএমইএ দীর্ঘদিন ধরে এসব উদ্যোক্তার জন্য একটি নিরাপদ এক্সিট পলিসির দাবি জানিয়ে আসছে। এই বিষয়ে আবারো সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
গত দুই মাসে পোশাক শিল্পে দীর্ঘ শ্রম অস্থিরতায় অনেক মাশুল দিতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাই না এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হোক। যারা শিল্প ও অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, তাদের কঠিন আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা বরাবরই আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতি সহানুভূতিশীল। সেই অবস্থান থেকেই আমরা শত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়েছি। এরপরও যদি পোশাক খাতে নৈরাজ্য চলে বা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে, তবে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবাইকেই নিতে হবে।
খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সবাই আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তার জন্য বিজিএমইএ বোর্ড সরকার ও সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তাছাড়া ক্রেতারাও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ওপর আস্থা রেখেছে। বিজিএমইএ বোর্ডের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারের নির্দেশনায় পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী গঠন হয়েছে এবং যৌথবাহিনী গার্মেন্টস অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিতভাবে টহল পরিচালনা করছে। বিজিএমইএ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু করেছে।
তিনি আরো বলেন, পোশাক কারখানাগুলোয় আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় বিজিএমইএ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দেয়া হয়। বিজিএমইএ বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গেও দেখা করেছে। তারপর বিজিএমইএর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পোশাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিককে ন্যায্যমূল্যে টিসিবি পণ্য বিক্রয় কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রয় কর্মসূচির উদ্বোধন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
বিজিএমইএর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক শিল্প কারখানাগুলোর জন্য বিএনবিসি-২০০৬ এর আলোকে স্টিল স্ট্রাকচারাল ভবনের জন্য ফায়ার রেজিস্ট্যান্স রেটিং প্রদানের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে।
সরকারের কাছে যেসব দাবি : তৈরি পোশাক খাতে প্রণোদনা পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। সংগঠনটি বলেছে, এলডিসি উত্তরণের কথা বলে পোশাকশিল্পের নগদ সহায়তার পরিমাণ কমানো হয়েছে। এ কারণে শিল্পে অনাকাক্সিক্ষত ঝুঁকি ও বিপর্যয়ের শঙ্কা বেড়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতের যেসব উদ্যোক্তা প্রতিকূলতার কারণে ব্যবসায় টিকতে পারছেন না, তাদের জন্য নিরাপদ ‘এক্সিট পলিসি’ বা ব্যবসা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, সম্প্রতি অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে নীতি সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, শিল্পের এই ক্রান্তিকালে পরবর্তী তিন মাসের জন্য কারখানার পরিষেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা; ব্যাংক খাতের সংস্কার যেন উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা; কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে তার জন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা; শিল্পকে ব্যবসাবান্ধব করতে যথাযথ নীতি সহায়তা প্রণয়নের বিষয়ে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন, শিল্পে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা ও বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণসহ টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি প্রণয়ন; টেক্সটাইল বর্জ্য বা ঝুটের বিষয়ে বহিরাগতদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া; ঋণখেলাপি গণ্য করার ক্ষেত্রে ৩টি কিস্তি ব্যর্থ হওয়ার পরিবর্তে ৬টি কিস্তি বিবেচনায় নেয়া এবং এক বছর পর্যন্ত বহাল রাখা।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক কারখানার চলমান রপ্তানি আদেশ ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ অবস্থায় সব ধরনের ঋণ শ্রেণিকরণ না করা এবং ঋণ পরিশোধে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ৪৪ অনুসারে পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়ার জন্য অর্থ উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। এছাড়া তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়েছে বিজিএমইএ।