স্বাস্থ্যসেবায় জনআস্থা ফেরানোর সুযোগ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
প্রতি বছরই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যান। এতে বিদেশে চলে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে বিদেশমুখীতা কমাতে দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক এক সেমিনারে জানানো হয়, বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে প্রতি বছর ব্যয় হয় ৪ বিলিয়ন ডলার।
তথ্যউপাত্ত বলছে, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ যাচ্ছে ভারতে। এরপর রয়েছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। খুব সামান্য অংশ যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতেও। বিদেশে যাওয়া রোগীর ৯২ শতাংশই যাচ্ছে ভারতে। বাকি ৮ শতাংশের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়।
এত বেশি সংখ্যায় মানুষ কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থা নেই। চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েই দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে যান। আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৪৯ ভাগ মানুষই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না, সেসঙ্গে স্থানীয় সেবা আন্তর্জাতিক মানের না হওযায় বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার প্রবণতা দিন দিনই বাড়ছে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের আস্থা ফেরানোর চেষ্টার কথা বিগত সব সরকার বললেও তা বাস্তবে হয়নি। এদিকে, জুলাই বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন কারণে বন্ধ আছে ভারতীয় ভিসা। মেডিকেল ভিসা চালু রাখা হলেও সেক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে গুরুত্ব বুঝে দেয়া হচ্ছে এ ভিসা। এই অবস্থায় যারা ছোটখাটো অসুখেও ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতেন সেই সুযোগ কিছুটা খর্ব হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের আস্থা ফেরানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, করোনা মহামারির সময় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ ছিল না। তখন সবাই দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। ভিসা জটিলতায় অনেকেই এখন যেতে পারছেন না। এই সুযোগে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ফেরাতে এই সেবা খাতের মান উন্নোয়নে আমাদের জোর দেয়া দরকার।
আরো পড়ুন: আধুনিক চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’
রোগীর সন্তুষ্টি বা আস্থা কেবল চিকিৎসা থেকে আসে না বরং পুরো হাসপাতালের ইকোসিস্টেম যেমন : নার্স, প্রশাসন, টেকনোলোজিস্ট সবাই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশেই রাখা সম্ভব হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া রোগীদের সর্বোচ্চ সংখ্যক হলেন ক্যান্সারের রোগী, যা মোট বিদেশগামী রোগীর ২১ শতাংশ। এরপর ১৮ শতাংশ যাচ্ছেন হৃদরোগের চিকিৎসা নিতে। এছাড়া বাকিরা বিদেশে যাচ্ছেন প্রজনন জটিলতা, অর্থোপেডিক চিকিৎসা, গ্যাস্ট্রোঅ্যান্ট্রোলজি, লিভার, কিডনি, চোখ, কান ও স্নায়বিক রোগের চিকিৎসার জন্য।
বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আবু জামিল ফয়সাল ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের মনোযোগ নিয়ে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। রোগীর প্রতি চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিক কেউই আন্তরিক নন। যতদিন পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা তৈরি হবে না, ততদিন চিকিৎসার জন্য মানুষের বিদেশমুখীতা ঠেকানো যাবে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)’র আহ্বায়ক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য খাতে কী কী গ্যাপ রয়েছে তার ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা দরকার। দেশেই যদি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রোগীরা সন্তুষ্ট থাকে তাহলে তারা বিদেশমুখী হবে না। সরকারের পক্ষ থেকেও একটা আলোচনা দরকার এবং বেসরকারি হাসপাতাল, মালিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যারা আছেন তাদেরও এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।