ছাগলকাণ্ডে ভাইরাল মতিউর রহমানের ঘরে আলাদীনের চেরাগ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম
১৫ লাখ টাকার ছাগলকাণ্ডে খোঁজ পাওয়া গেল এক রাঘববোয়ালের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মো. মতিউর রহমান।
পুত্র মুশফিকুর রহমান ইফাত কাণ্ডে যেন আকাশ থেকে ভূপাতিত হলেন দেশজুড়ে আলোচিত উচ্চপদস্থ এই সরকারি কর্মকর্তা। ইফাত তার সন্তান নয় বলেও পার পেলেন না। ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জানিয়েছেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই তার বাবা।
মুশফিকুর রহমান ইফাত ছাড়াও মতিউর রহমানের মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার কানাডায় ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
শুধু এই দুই সন্তানের সম্পত্তি দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে শত বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে লাকি পার্ক নামে আলিসান রিসোর্ট, যার বর্তমান নাম ওয়ান্ডার পার্ক। এ ছাড়াও নরসিংদীর নাগরিয়াকান্দির গোল্ডেন স্টার পার্কে রয়েছে অংশীদারত্ব। স্ত্রীর নামে মিলছে এমন অসংখ্য অবৈধ সম্পদের বিবরণ।
গত ১৮ বছরের ব্যবধানে চার দফা উচ্চপদস্থ এই সরকারি কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে টিম গঠন করা হলেও রহস্যজনকভাবে প্রতিবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে তাকে দেওয়া হয় ‘ক্লিনচিট।’ তবে এবার তার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসায় নড়েচড়ে বসেছে দুদক। হাইকোর্টও তার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মতিউর রহমানের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এদিকে ভোরের কাগজ অনুসন্ধানী টিম মতিউর রহমানের ঘরে আলাদীনের চেরাগের খোঁজ পেয়েছে।
মতিউর রহমানের বাড়ি বরিশালের মুলাদি উপজেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন মতিউর রহমান। ১১তম বিসিএসে বাণিজ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন মতিউর রহমান। পরে এই ক্যাডারের সাত কর্মকর্তাকে কাস্টমস ক্যাডারে একীভূত করা হয়। মতিউর রহমানও তাদের মধ্যে একজন।
বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের ঔরসে দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর গর্ভে জন্ম ভাইরাল হওয়া তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত।
প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষক। বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তার গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব। আর মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার বিলাসী জীবনের খোঁজ মিলেছে কানাডায়।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শুরুর দিকে লালমাটিয়ার একই ফ্ল্যাটে ছিল দুই স্ত্রীর বসবাস। কিন্তু তা সুখের হয়নি। দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছালে লালমাটিয়া থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী চলে আসেন অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে।সেখানে তার নজরকাড়া ফ্ল্যাট সাজানো হয় প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়ে।
১৯৯৬ ও ১৯৯৭ এই দুই বছর বেনাপোল বন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার ছিলেন মতিউর রহমান। তৎকালীন সময়েই তার বিরুদ্ধে বেপরোয়া ঘুস ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে বেনাপোল বন্দর থেকেই তিনি অঢেল কামিয়েছিলেন। সেখান থেকেই মূলত তার ‘অবৈধ আয়ের’ হাতেখড়ি বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্যাডার পরিবর্তন করে বাণিজ্য ক্যাডারের ১১ ব্যাচ থেকে কাস্টমসের ১৩ ব্যাচের সঙ্গে যোগ দেন ড. মতিউর রহমান। নতুন ক্যাডারে যুক্ত হওয়ার পরই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্পদ বাড়তে থাকে তার। ড. মতিউর রহমানের উত্থান মূলত ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার থাকাকালে। পরে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক জায়গায় পদায়ন হয়েছে তারবিভিন্ন কোম্পানিতে ভ্যাট ডিমান্ড করে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য হিসেবে কাস্টম ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে ১৫ বছরে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ।
এই তালিকায় আছে পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউসের অংশীদারত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, জমি ও বিনোদন পার্ক। সন্তানদের নামে রয়েছে ডজনখানেক কোম্পানির মালিকানা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, মতিউর রহমান শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাজারসংশ্লিষ্টদের কাছে তার পরিচয় ‘গেমলার’ হিসাবে। তার সঙ্গে দুদকের অনেক কর্মকর্তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকায় তিনি পার পেয়ে যান। মতিউর রহমানের দাবি, তার বিপুল সম্পদের মূল উৎস পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ। তবে সেখানেও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে রয়েছে কারসাজির অভিযোগ। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হলেও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী।
মতিউর রহমান এই তরুণকে ছেলে হিসেবে অস্বীকার করলেও ইফাতের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া দুটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন তার পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজের নামে। আর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন মতিউর রহমানের দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা।
মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে অনুসন্ধানে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র এসেছে।
জানা গেছে, মতিউর রহমান বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় থাকেন। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
জানা গেছ, শুধু রাজধানী ঢাকা বা গাজীপুরে নয়, মতিউর রহমান অঢেল সম্পত্তি কিনেছেন শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীতেও। তার স্ত্রী লায়লা কানিজ আগে সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন।প্রভাবশালী স্বামীর প্রভাবে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লার নামে পার্ক-রিসোর্ট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট।রাজধানীর বসুন্ধরা,গাজীপুর সদর, খিলগাঁও মৌজায় এবং সাভারে অসংখ্য জমি রয়েছে স্ত্রী ও ছেলে-সন্তানের নামে।