ইনুকে ফোনে হাসিনা: হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে

বাসস
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
‘আকাশ থেকে নামবে, তখন দুই পাশ দিয়ে ধরবে। আর হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে... র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর দিয়ে মারবে।’ শেখ হাসিনা ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর মধ্যকার এক কল রেকর্ডের এই কথোপকথন শোনা যায়। বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) যে কল রেকর্ডটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্লে করে শোনানো হয়।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৫৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে এদিন জবানবন্দি দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া জবানবন্দিতে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও ৩টি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়। জব্দ কৃত কল রেকর্ড থেকে আজ ট্র্যাইব্যুনালে ৪টি কল রেকর্ড প্লে করে শোনানো হয়। শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর মধ্যকার একটি কল রেকর্ডের কথোপকথনে শোনা যায় যে....
হাসানুল হক ইনু: হ্যালো, জি জি স্লামালাইকুম।
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ, ওয়ালাইকুমস্লাম, কী হইছে?
হাসানুল হক ইনু: ইনু বলছিলাম... না একটা কথা... আমি মনে করি যে আপনার পদক্ষেপটা সঠিকই হয়েছে। এখন পর্যন্ত যা রিপোর্ট বাংলাদেশে পাচ্ছি আরকি। খালি ঢাকাতে আপনার রামপুরার দিকে এবং...
শেখ হাসিনা: না রামপুরা ক্লিয়ার, শনির আখড়ায় একটু ঝামেলা এখন আছে...
হাসানুল হক ইনু: শনির আখড়ায় কিছু মোল্লারাই...
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ জানি, না, খালি মোল্লা না ওইখানে অনেক মাদরাসা।
হাসানুল হক ইনু: মাদরাসা আছে ওই...
শেখ হাসিনা: ... ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে... মাইকিং করতে হচ্ছে আরকি... নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে দিচ্ছে না আর্মিকে আমরা... নামাচ্ছি।
হাসানুল হক ইনু: ও আচ্ছা...
শেখ হাসিনা: না আমি বলছি ক্যাজুয়াল্টির দরকার নাই। ওরা ব্যারিকেড দিয়ে আছে তো, ঠিকাছে, আকাশ থেকে নামবে, তখন দুই পাশ দিয়ে ধরবে... মেসেজটা দিয়ে দিতে পারেন যে...সেনা পাঠানো হচ্ছে... আর হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে... র্যাবের হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর দিয়ে মারবে।
হাসানুল হক ইনু: আচ্ছা ওপর দিয়ে সাউন্ড বোম যাবে আরকি, ঠিকাছে... আমি একটা পয়েন্ট আপনাকে একটু নজরে আনার জন্য রিকোয়েস্ট করতেছি যে, কারফিউ ধরেন দুই-পাঁচদিন যা চলল, চলল। কিন্তু কারফিউয়ের পর যেন আর মিছিল না নামতে পারে সেজন্য একট হোমওয়ার্ক করতে, করা দরকার যেরকম আমি উত্তরা, বাড্ডা, গুলশান, যাত্রাবাড়ীতে যারা মিছিল লিড করছে সেইগুলা চিহ্নিত আরকি... ছাত্রদল, বিএনপির ছেলে-মেয়ে, ছেলেরা, শিবিরের... মানে ধরেন রিজভীকে এরেস্ট করা বা রুহুলকে এরেস্ট করা ইম্পর্টেন্ট না, ইস্পটে হচ্ছে ওইখানে গ্রাউন্ডে যে মিছিলটা লিড করেছে, আমি কুষ্টিয়া জেলাতে এসপি সেভাবে অলরেডি তালিকা করে ফেলছে। ওখানে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। একটা ছররা গুলিতে খালি একজনের পায়ে লাগছে, উনি ম্যানেজ করছে। ম্যানেজ করছে। উনি অলরেডি কম্পিউটারে ছবি দেখে দেখে ছেলেগুলার তালিকা করতেছে। তা আমি বললাম যে ছেলেগুলাকে আজকে রাত্রের ভেতরে পিকআপ করে নাও।
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ শিওর।
হাসানুল হক ইনু: যেন মিছিলটা লিড না করতে পারে। তা আমি ঢাকা শহরের জন্য বলছি যে আপনার গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই তালিকা করতে পারবে যে উত্তরায় কারা।
শেখ হাসিনা: ... খালি গোয়েন্দারটা না, লোকাল লিডারদেরও করা উচিত।
হাসানুল হক ইনু: লোকাল লিডার ওইখানে এমপি খসরু ও হাসান হাবিব আছে। আমার কালকের যে রিপোর্ট হাসান হাবিব কিন্তু। ও রাগ করে খসরুর ওপর ছেড়ে দিছে যে এমপি সাহেব মোকাবিলা করুক.....
শেখ হাসিনা: খসরু তো পারবে না, খসরু তো লোকাল না, হাসান তো লোকাল, ওদেরতো লোকজন আছে।
হাসানুল হক ইনু: লোকাল না তো। রাইট, হাসান হাবিব নামেনি। আর এখানে ওয়াকিলও সামলাইতে পারেনি, ও দুই লাইনে পা দিয়ে চলে। তো আমার কথা হচ্ছে যে একটু লোকাল লিডারদের সাহায্যে তালিকাটা করে নিয়ে আজকের রাত্রের ভেতরে সব কাস্টডিতে নিতে পারেন তাহলে কোনো জায়গায়... আর মোহাম্মদপুরে একটা পাঁয়তারা ছিল। কালকে আপনি রাত বারোটায় যেয়ে খুব ভালো করছেন। আজ কিন্তু গণভবন ঘেরাও করতো। কিন্তু মোহাম্মদপুরে ওইখান থেকে রেডি হচ্ছিল কালকে, মানে এইটা, সুতরাং...
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ এইটা কয়েকদিন ধরে করতেছে।
হাসানুল হক ইনু: ডিসিশনটা খুবই কারেক্ট হইছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা: থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ... আমরা হলাম রণক্ষেত্রের সাথী।
হাসানুল হক ইনু: রণক্ষেত্রের সাথী। তা আপনি একটু দয়া করে...এই পিকআপটা করতে বলেন...
শেখ হাসিনা: না এইটা বলা আছে, বলতেছি, বলতেছি।
হাসানুল হক ইনু: ওইটা একটু হোমওয়ার্ক করতে বলেন, করে এরেস্ট করে ফেলতে বলেন আজকে। মানে সবই এরেস্ট করে ফেললে আর মিছিল করার লোক থাকবে না।
শেখ হাসিনা: লিসেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান। এরেস্ট করে...
হাসানুল হক ইনু: আরেকটা রিকোয়েস্ট আমার যে ইন্টারনেট আমার মনে হয় চালু করতে পারেন, এটা আমাদেরই কাজে লাগবে।
শেখ হাসিনা: ভাই কি যে চালু করবো সবতো পোড়াই দিছে। ডাটা সেন্টারও পোড়ায় দিছেই পোড়ায় দিছে। এখন ওই নতুন তারতুর কিনে জোড়া লাগাতে হবে।
হাসানুল হক ইনু: ... আমি যে কথাটা বলার চেষ্টা... আমি একাত্তরে রাত আটটার সময় যাবো একা কথা বলবো। আমি বলবো যে সরকারের সাথে কোটা আন্দোলনকারীর কোনো বিরোধ নাই। সরকারের সাথে বিরোধ হচ্ছে নাশকতাকারী বিএনপি-জামাতের।
শেখ হাসিনা: না ওইটা তো বলা হয়েছে। ওইটা আমি নিজেও বলছি...
হাসানুল হক ইনু: ... এই জিনিস্টা প্রোপাগান্ডায় আনতে হবে যদি ইন্টারনেট থাকে, গণমাধ্যম দিয়ে আমরা পুরা নিউজে ফ্লাড করে দিলাম...
শেখ হাসিনা: ইন্টারনেট পাবো কোথায়? ইন্টারনেট পোড়ায় দিছে। জীবনে... আমি তো আর আনবো না, যদি অন্য সরকার আসে তাহলে আনবে... আমি দিছি ইন্টারনেট, ওরা পোড়াইতে থাকুক, ওইটা চলতে হবে...
হাসানুল হক ইনু: অন্য সরকার, বাংলাদেশে ইনশাআল্লাহ অন্য সরকার আসবে না।
শেখ হাসিনা: আসুক, না আমি আর পারবো না... যাচ্ছি এখন
হাসানুল হক ইনু: না না... যাওয়া দরকার নাই
শেখ হাসিনা: জামায়াতকে শায়েস্তা করে থুয়ে যেতে হবে
হাসানুল হক ইনু: ...
শেখ হাসিনা: ... আপনার যেখানে যেখানে লোক আছে তালিকাগুলি আপনারা করান, আমরাও করাচ্ছি।
হাসানুল হক ইনু: ...আপনি এই... জামাত শিবিরের মেরুদণ্ডটা আবার ভেঙে দেন ঢাকা শহরে।
শেখ হাসিনা: একেবারে...
হাসানুল হক ইনু: ... এক্সপোজ হইছে আরকি, একটু দেখেন, আর আমি বাদবাকি আমাকে যেটা বলবেন আমি ইনশাআল্লাহ করবো, কোনো অসুবিধা নাই।
শেখ হাসিনা: না ওই তালিকাগুলি একটু করায় ফালান...এই ইস্যুতে যা পারেন, শিবির যে কয়টা আছে, যা আছে সব বের করেন...
হাসানুল হক ইনু: বুঝছি আমি বুঝছি। জি স্লামুয়ালাইকুম
শেখ হাসিনা: ঠিকাছে আচ্ছা।
হাসানুল হক ইনু: জি স্লামুয়ালাইকুম
শেখ হাসিনা: থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ...
এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করছেন। সেই সাথে অপর প্রসিকিউটররা শুনানিতে উপস্থিত থাকেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্র্যাইব্যুনাল। পরবর্তীতে এই মামলার রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।