আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় রোববারটি পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় বাবা দিবস হিসেবে। মা দিবসের মতো ততোটা ঘটা করে না হলেও, এই দিনটিতে সন্তানরা স্মরণ করে জীবনের এক অদৃশ্য পাহাড়—বাবাকে, যিনি নীরবে নিঃস্বার্থভাবে সব দিয়ে যান, বিনিময়ে কিছু না চেয়ে। এই দিনটি যেন এক নিঃশব্দ ভালোবাসার অনুরণন, এক গভীর শ্রদ্ধা আর স্মৃতির উপলক্ষ।

বাবা—এই শব্দটা কোনো একক সংজ্ঞায় বাঁধা নয়। তিনি শুধু একজন মানুষ নন, তিনি এক আশ্রয়, এক নির্ভরতার প্রতীক। অনেক সময় মুখে কঠোর, চোখে ধৈর্য, অথচ হৃদয়ের গভীরে অফুরন্ত ভালোবাসা। মা যতটা আবেগের প্রকাশ, বাবা ততটাই আবেগের সংযম। সন্তানের চোখে তিনি এক সুপারহিরো, যে ক্লান্ত হয় না, কাঁদে না, আর্থিক চিন্তা লুকিয়ে রেখে হাসে, আর প্রয়োজন হলে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সন্তানের স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত থাকে।

বাবারা কাঁদেন না—এমন একটা ধারণা আমাদের সমাজে অনেকদিনের। অথচ ঠিক গভীর রাতে ঘরের কোণে বসে থাকা বাবার মুখেই সবচেয়ে বেশি চিন্তার রেখা দেখা যায়। সন্তানের পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার প্রয়োজন, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা—এসবের ভার নীরবে বহন করেন তিনি।

আজ সেই বাবাদের সম্মান জানানোর দিন, তাদের বলা “আমিও তোমাকে ভালোবাসি”, যা প্রতিদিন বলা হয় না, অথচ প্রতিদিন অনুভব করা হয়।

অনেকেই আজ বাবাকে মুঠোফোনে একটি বার্তা পাঠাবে, কেউ একটি কার্ডে লিখে দেবে ভালোবাসা, আবার কেউ হয়তো বাবার সঙ্গে কাটাবে একটি নিরবিচার বিকেল। কেউ কেউ আজ বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি বলবে—“বাবা, তুমি থাকো বা না থাকো, আমি প্রতিদিন তোমার অভাব টের পাই।”

আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বাবার ভূমিকা অনন্য। মাইকেল মধুসূদনের সেই বিখ্যাত চিঠি—"বাবার স্নেহে আর একবার ফিরিয়া আসিতে ইচ্ছা করে"—আজও বাঙালির হৃদয়ে দোলা দেয়। অথচ বাবাকে নিয়ে লেখা গানে, কবিতায়, গল্পে আমরা যতটা কম দেখি, তা হয়তো সমাজে বাবার নীরব ভূমিকারই প্রতিচ্ছবি।

আজকের দিনে, সেই বাবাদের কথা বলি, যারা শ্রমজীবী, দিনমজুর, রিকশাচালক কিংবা কৃষক। যাদের মুখে রাজনীতি নেই, কূটনীতি নেই, আছে কেবল সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার এক অদম্য সাধনা। তারাও বাবা, যারা হয়তো সন্তানের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে গিয়ে নিজের খাওয়াটা ভুলে যান। তারাও বাবা, যারা প্রবাসে থেকে সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো কাটিয়ে দেন হাজার মাইল দূরে।

আজকের এই দিনে বাবার কাছে গিয়ে বলা উচিত—“ধন্য আমি, কারণ তোমার মতো একজন মানুষ আমার ছায়া হয়ে আছো”। যাদের বাবা জীবিত, তারা যেন সময় নষ্ট না করে এই ভালোবাসাটা জানিয়ে দেয়। আর যাদের বাবা আজ শুধুই স্মৃতি, তাদের মনে আজ একটু বেশি কাঁপে আবেগ, একটু বেশি ভিজে ওঠে চোখের কোণ।

বাবা দিবসের ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বের হলেও দিবসটি এখন বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশেই উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশেও বাবাদের সম্মান জানাতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করেছে বিশেষ অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা এবং নানা আয়োজন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাবা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সনোরা স্মার্ট ডড নামে এক নারীর। ১৯০৯ সালের আগে ওয়াশিংটনে বাবা দিবস বলে কোনও বিশেষ দিন ছিল না। সে সময় স্থানীয় গির্জায় ডড মা দিবস পালনের কথা শোনেন।  মা দিবস পালনের রীতি রয়েছে কিন্তু বাবা দিবস পালনের রীতি নেই জেনে তিনি ভীষণ অবাক হন। তারপর তিনি বাবা দিবসের স্বীকৃতির জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ডড তার বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মা ছিল না তার। মায়ের মৃত্যুর পর শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও তাদের সাত ভাইবোনকে বড় করে তুলেছিলেন তাদের সিঙ্গেল বাবা। বাবার এই ত্যাগ দেখে ডডের মনে হলো, মা দিবসের এত আয়োজন হলে বাবা দিবস কেন বাদ থাকবে। বাবাকে সম্মান জানানোর জন্যও একটা দিন থাকা দরকার।

তারপর অনেক চেষ্টা করে দীর্ঘ এক বছরের সাধনায় স্থানীয় কমিউনিটিগুলোতে বাবা দিবস পালন করতে পারেন ডড। ১৯১০ সালের ১৯ জুন বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বাবা দিবস।

পৃথিবীর প্রতিটি বাবার জন্য আজকের এই দিন একটি নমস্যতা। তারা হয়তো কোনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে সম্মাননা নেন না, হয়তো তাদের জন্য কোনো ব্যানার টাঙানো হয় না—কিন্তু সন্তানদের জীবনের প্রতিটি অর্জনের মূল স্তম্ভ তারাই। এই বিশেষ দিনে আমাদের কামনা—প্রত্যেক বাবা সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক, সন্তানের চোখে একজন নায়ক হয়ে থাকুক। আর আমরা যেন কখনোই তাদের অবদান ভুলে না যাই। বাবার প্রতি ভালোবাসা হোক নিঃশব্দে বলা, হৃদয়ের গভীরে লেখা।