×

জাতীয়

কপ৩০

‘ভঙ্গুর’ প্রতিশ্রুতির কারখানা

Icon

সেবিকা দেবনাথ

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:০০ পিএম

‘ভঙ্গুর’ প্রতিশ্রুতির কারখানা

ছবি : সংগৃহীত

নানা আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, দর-কষাকষি এবং অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে কপ৩০। তবে শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট নন অংশগ্রহণকারীরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কপ৩০ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। অনেকের মনেই প্রশ্ন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এই মহামঞ্চ কি শুধুই একটি ‘ভঙ্গুর’ প্রতিশ্রুতির কারখানা? 

পরিবেশকর্মীরা বলছেন, ৩ বছর আগে যখন ব্রাজিলকে এ জলবায়ু আলোচনা আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন থেকেই প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। যে দেশটিতে ধরিত্রী সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক জলবায়ু যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই আমাজন তীরবর্তী ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সত্যিই জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেবে বলে আশা করা হয়েছিল; কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনার এই ৩০তম সংস্করণটি পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতোই হতাশাজনক পরিণতির পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, গভীর হতাশা নিয়ে সম্মেলন শেষ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কপ৩০ এ বাংলাদেশের মতো জলবায়ু সংকটাপন্ন দেশগুলোর অপ্রাপ্তির বোঝাটা অনেক ভারী। কারণ, সম্মেলন ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অর্থ প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা দেয়নি। অধিক মাত্রায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ দেখবে, মর্মে প্রতিশ্রুতি দিলেও গত কয়েক বছরে প্রতিশ্রুতি পূরণে আন্তরিকতা দেখা যায়নি।

ব্রাজিলের বেলেমে ১৩ দিন ধরে আলোচনা চললেও শেষ পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। চুক্তিতে ১৯৪টি দেশ সম্মত হলেও তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক। অর্থাৎ বাধ্যতামূলক কোনো বিধান নেই। যে কোনো দেশ পরবর্তীতে চাইলে চুক্তি থেকে সরে দাঁড়াতে পারবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীরা বলছেন, এ ধরনের নমনীয় কাঠামো অনেকের কাছে হতাশাজনক। কারণ জলবায়ু সংকটের এই সময়ে শক্তিশালী বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রও এবার মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠায়নি। ফলে শুরু থেকেই এই সম্মেলনের প্রভাব প্রশ্নের মুখে পড়ে।

এবারের চুক্তি অনেককে হতাশ করেছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের জলবায়ু সেক্রেটারিয়েটের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিয়েল বলেছেন, দায় স্বীকারে অস্বীকৃতি এবং নানা বিষয়ে বিভক্ত একটি বছরে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা শেষ পর্যন্ত একমত হতে পেরেছেন, এটাই প্রশংসনীয়। আমি বলছি না আমরা জলবায়ু লড়াইয়ে জিতেছি। তবে আমরা এখনো নিঃসন্দেহে সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছি। আমরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছি।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার কপ৩০ সম্মেলনকে ‘আশানুরূপ ছোট পদক্ষেপ’ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমারেখা রক্ষার পথে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। সম্মেলনে জলবায়ু রক্ষায় নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর দুর্বল প্রতিশ্রুতি এই সম্মেলনের লক্ষ্যকে ব্যর্থ করেছে। 

তিনি আরো বলেন, সম্মেলনে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজন তহবিল ৩ গুণ বাড়ানোর প্রতিশ্রæতি দেয়া হলেও এই ১২০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক তহবিল ২০৩৫ সালে দেয়া হবে এবং উক্ত তহবিলের কার্যকারিতা ২০২৬ সাল থেকে শুরু হবে। ফলে এটি অনেক দেশকেই তাদের জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট সহায়তা দিতে পারবে না। 

দ্য গার্ডিয়ানের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলো বছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি ডলার পেতে পারে। কিন্তু এই অর্থ নতুন নয়। গত বছর ধনী দেশগুলো যে ৩০ হাজার কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেই পুল থেকেই এই বরাদ্দ ধরা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, চুক্তিটি একটি অগ্রগতি, তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সামনে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কারণ অতীতের প্রতিশ্রুতি এখনো পূরণ হয়নি। 

সব মিলিয়ে অর্থায়ন নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছিল, তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। অনেকে মনে করেন, চুক্তিটি নতুন তহবিল তৈরি করার সুযোগ হারিয়েছে।

জাস্ট ট্রানজিশন ম্যাকানিজম গ্রহণকে এবারের সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি বলেন এটি সর্বস্তরের মানুষ, শ্রমিক, নারী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করে সবুজ অর্থনীতিতে স্থানান্তর নিশ্চিত করবে। তবে এই মেকানিজমের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন চূড়ান্ত চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। এবারের চূড়ান্ত চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি-সম্পর্কিত কোনো বিষয়বস্তুর সরাসরি উল্লেখ নেই। আরো একটি হতাশাজনক বিষয় হলো, মূল চুক্তিতে বন সংরক্ষণের রোডম্যাপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ কপ৩০ আয়োজিত হয়েছিল আমাজনের কোল ঘেঁষে এবং বনগুলো সর্বদাই বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। তবে ব্রাজিল নতুন ‘ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ফোরএভার ফ্যাসিলিটি’ নামে একটি তহবিল চালু করেছে- যা দেশগুলোকে গাছ সংরক্ষণে অর্থ সহায়তা করবে। যদিও কপ৩০ এ ছোট এবং সীমিত কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সীমিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়, বাধ্যতামূলক এবং সমন্বিত পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি। এই সম্মেলনের একমাত্র প্রাপ্তি শুধু ট্রানজিশনের স্বীকৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প থেকে ক্লিন এনার্জিতে স্থানান্তরিত হওয়া শ্রমিকদের সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাংলাদেশ সেই তালিকায় অন্যতম। কিন্তু কপ৩০ এ এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি- যা সরাসরি এসব দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। উপকূলীয় এলাকা, কৃষি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা- সব জায়গায় জলবায়ুর প্রভাব বাড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের উপক‚ল, শহর ও কৃষিজমিতে। অন্যদিকে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নেই। আগের প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক সময় বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে কপ৩০ বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি স্বস্তি আনতে পারেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ আগুন

কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ আগুন

তদন্তে বাধা দিলে তালিকা প্রকাশ করা হবে: দুদক চেয়ারম্যান

তদন্তে বাধা দিলে তালিকা প্রকাশ করা হবে: দুদক চেয়ারম্যান

ফের বাড়লো স্বর্ণের দাম

ফের বাড়লো স্বর্ণের দাম

শার্ম এল শেইখ: নীল সমুদ্র, সোনালি মরু আর এক নীরব স্বর্গের সন্ধান

শার্ম এল শেইখ: নীল সমুদ্র, সোনালি মরু আর এক নীরব স্বর্গের সন্ধান

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App