প্রকৃতির সান্নিধ্যে মধুচন্দ্রিমায়

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মারুফ হাসান
কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, যেখানে সোনালি বালু আর নীল আকাশ মেলে ধরেছে এক অপূর্ব দৃশ্য, সেখানে এক এমন রিসোর্ট রয়েছে যা আপনাকে এনে দেবে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। শীতের কুয়াশা মাখা সময়ে যখন তানভীর- ক্রিস্তিনা প্রথম রিসোর্টে প্রবেশ করে, মনে হচ্ছিল যেন একটি পুরানো বইয়ের পাতায় পা রেখেছে এই যুগল। মৃদু-মন্দসাগরের হাওয়া, সোনালি আভায় ভেসে থাকা বালুকাবেলা, আর চারপাশে অগণিত গাছপালা -এই দৃশ্য যেন কিছুটা কবিতার মত, যেখানে সময় থেমে গেছে। প্রকৃতির সিম্ফনি, পাখির গান আর সমুদ্রের দূরবর্তী গর্জন- কেমন উপভোগ্য হবে এই দম্পতির মধুচন্দ্রিমা!
প্লেনের দরজা দিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে এক রাশ নোনা হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলো তানভীরের চোখে মুখে। মনের মাঝে এক রাশ স্মৃতি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। দামী রোদ চশমার আড়ালে এক মূহুর্তে অগণিত দৃশ্যের কোলাজ কিছুক্ষণের জন্য তাকে থমকে দিলো। দইজ্জার পাড়, সারি সারি সাম্পান, জাল টানা হাত, ঝিনুক কুড়ানো কিশোরী মেয়ের শৈশব-কৈশোরের কক্সবাজার।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তাদের গাড়ি। পাশে ক্রিস্তিনা অবাক কৌতূহলে জানালা দিয়ে সব দেখছ। আর তানভীর তার শৈশবের শহরটা খুঁজছ। আগের চাইতে অনেক মানুষ, জমজমাট শহর, সারি সারি হোটেল। সে যখন এই শহর ছেড়ে বিদেশে পারি জমায় তখন অনেকদূর থেকে সাগর দেখা যেত। মাঝে থাকতো সবুজ ধানক্ষেত। কিন্তু আজ এখনো সাগরের দেখা পায়নাই। আর চারদিকে প্রচুর আবর্জনা। এতোদিন বিদেশে থেকে তার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। ইকো ট্যুরিজম টার্মটার সাথে সে পরিচিত। তার সবসময় মনে হতো তার নিজের শহরেটা যদি এমন কনসেপ্টে সাজানো যায়, তাহলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এই যত্র-তত্র উন্নয়ন তাকে একটু বিমর্ষ কর। এইসব ভাবতে ভাবতেই তাদের গাড়ি মেরিন ড্রাইভ রাস্তায় এসে ওঠে। এই প্রথম ভালোমত সাগরের দেখা পায় তানভীর। মনটা ভালো হয়ে যায় তার। ক্রিস্তিনায় কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি আর সাগরের ঢেউ দেখে উচ্ছসিত। বাকি পথটা সাগর পার ধরে এই রোমান্টিক ড্রাইভ উপভোগ করে এই হানিমুন কাপল। প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে করতেই রিসোর্টে পৌঁছে যায় তারা। মারমেইড বিচ রিসোর্ট। সত্যি বলতে যদিও বিদেশে থাকতে তার কিছু বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের কাছে তানভীর এই রিসোর্টের নাম দুই একবার শুনছে কিন্তু সেই অর্থে তেমন কোনো ধারণা ছিল না এই রিসোর্ট সম্পর্কে। আসলে ক্রিস্টিনার জেদেই বাংলাদেশে হানিমুনে আসা, তার ইচ্ছা ছিল বালি বা থাইল্যান্ড। বিদেশের আধুনিক পর্যটনের সেসব সুযোগ সুবিধা থাকার পরও দুইজন একান্তে প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কাটাতে পারবে। কিন্তু ক্রিস্তিনায় ইচ্ছা সে এই হানিমুনে শুধু তানভীরের নিজস¦তার বাইরে তানভীরের বেড়ে উঠা প্রাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও জানতে বুজতে চায়। তখন অনেক খুঁজে তানভীর মারমেইড রিসোর্ট বুকিং করে। যদিও তার মধ্যে এখনো সন্দেহ রয়েই গেছে শহরের যে অবস্থা সে আসতে আসতে দেখলো তাতে কতটা সে ক্রিস্টিনাকে নিজের শৈশবের পরিবেশ প্রতিবেশ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে! দেখা যাক। প্রথমে ঢুকতেই রিসেপশন তাদের চেকইন করতে হলো। সেখানে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করা হলো আর সাথে ডাবের পানি দিলো ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস হিসেবে। এতদিন বাদে দেশি ডাবের পানি খেয়ে তানভীর প্রাণটা জুড়ায় গেলো। সে আশা করে নাই ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস হিসেবে সে এই ডাবের পানি পাবে, যা কক্সবাজারের একটা ঐতিহ্য। এছাড়া যে ফুল দিয়ে তাদের বরণ করা হলো সেগুলা সব বাড়ির উঠানে জন্ম নেয়া জবা ফুল আর জংলী সব ফুল। কোনো আড়ম্বর নাই অথচ কি স্নিগ্ধ। শুরুটা ভালোই হল। দেখা যাক সামনে কি হয়।
চেক ইন করেই তারা চললো তাদের ভিলার দিকে। যেতে যা দেখলো তাতে তানভীর সত্যি বিস্মিত হলো। পুরো রিসোর্ট তাই গড়ে উঠেছে দেশীয় সব গাছপালায় ভরা এক বাগানের মাঝে। এই বাগান ঠিক পরিকল্পিত না কিন্তু পরিচর্যার ছোয়া স্পষ্ট। একদম প্রাকৃতিক কিন্তু যতœ নিয়ে রক্ষা কর। ঠিক যেমন আমাদের গ্রাম বাংলার চারপাশটা হয়। এইসব গাছপালার মাঝে গড়ে উঠেছে আলাদা একেকটা ঘর সামনে উঠান, ঠিক বাংলার গ্রামীণ ভিটে গুলার আদলে। আর প্রতিটা ঘরের গায়ে নানান সব রঙিন চিত্রকলা, সেখানে আমাদের দেশীয় সব মিথোলজিক্যাল চরিত্র আর মোটিফ দেখা যায়। প্রতিটা ভিলা বা কটেজের সীমানা নির্ধারণ বা প্রাইভেসি মেইনটেইন করা হয়েছে একদম মাটির দেয়াল বা কাঠের বেড়া, কখনো শুধুমাত্র প্রাকৃতিক গাছের সারি বেবহার করে।
এরকম দেখতেই দেখতেই চলে এক সময় তানভীরকে ভিলা চলে আসলো। ভিলায় ঢুকে তানভীরের সকল আশঙ্কা দূর হয়ে গেলো। এখানে প্রাকৃতিক সব কিছু ব্যবহার করে, রক্ষা করেই গড়ে উঠেছে সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা।
ভিলার সামনে বিস্তীর্ণ উঠান আর সেই উঠান যেন গিয়ে মিশছে ঠিক সৈকতে, সৈকত পেরোলেই সাগর। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় জেলেরা জাল টানছে ছোট ছোট চিংড়ি আর কাঁকড়া ধরার জন্য। সামান্য দূরেই রেজু খাল ব্রিজ, ভালো করে লক্ষ্য করলে সাম্পানও চোখে পরে। প্রকৃতি যেন ঠিক তাদের ঘরের মাঝে ঢুকে পড়েছে। প্রকৃতি আর বাসস্থান এখানে আলাদা আলাদা নয়, দুটো একসাথে একই সত্তা। এমন ইকো ট্যুরিজম সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখে এসেছে। সে নিশ্চিত কক্সবাজারে হানিমুনের সিদ্ধান্ত ভুল হয় নাই। বরং আগামী কয়েকটা দিন যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন হতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। থাঙ্কস টু মারমেইড রিসোর্ট। উল্লেখ্য, মারমেইড বিচ রিসোর্ট, যা মেরিন ড্রাইভ রোডের পাশে পেঁচার দ্বীপের কোণে অবস্থিত, কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই নয়, এখানে আসলে এক অনন্য প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়।