বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আজকের বাংলাদেশ
প্রকৃত সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণ
সাক্ষাৎকার : গোলাম কুদ্দুছ

মুহাম্মদ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ বলেছেন, একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণের মূল চাবিকাঠি হলো বাহাত্তরের সংবিধান। রাষ্ট্রের চার মূলনীতি- ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সেই রাষ্ট্রীয় চার নীতি সংবিধান থেকে বিলুপ্তি হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক ও স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় এসেছিলেন। তারা এই আদর্শটিকে সংবিধান থেকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের চার মূল নীতিকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তারপরও এগুলোর জন্য লড়াই-সংগ্রাম চলেছে দীর্ঘদিন। সেই লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। শুক্রবার (২ আগস্ট) ভোরের কাগজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে বারবার। বর্তমানে একটানা চার মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন তিনি। এই সময়ে রাষ্ট্রের উন্নতি হয়েছে অনেক। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ জাতির উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে এটা ঠিক; কিন্তু আমাদের চেতনাগত উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। চিন্তার জগতের অন্ধত্বটা রয়েই গেল। কারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে জাগরণের দরকার ছিল, সেটা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি।
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, একটা মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক, প্রতিগতিবাদী প্রজন্ম তৈরির যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল, সেটা বাস্তবায়নের উপযোগী যথাযথ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সেভাবে নেয়া হয়নি। তবে যতটুকু হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক সংকট হলে তা কাটিয়ে ওঠা যায়; কিন্তু চেতনাগত সংকট হলে সেটি কাটানো খুবই দুষ্কর। আর এটিই হলো আমাদের প্রধান সংকট। মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ ও তরুণ প্রজন্মকে যেভাবে তৈরি করার প্রত্যাশা ছিল, সেটা আমরা সেভাবে করতে পারিনি। আমরা সবকিছু শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। একেবারে তৃণমূল থেকে জেগে ওঠার যে পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল- সেই গ্রাম থেকে গ্রামের সংস্কৃতির জাগরণ সৃষ্টি করা, গ্রামের ক্লাব সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা, গ্রামগঞ্জে বা উপজেলা পর্যায়ে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, সক্রিয়-আধাসক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে একটি প্রকৃত সাংস্কৃতিক সংগঠনে পরিচালিত করা, গড়ে তোলা, গ্রাম পর্যায়ে শিশু সংগঠন গড়ে তোলা, তৃণমূল পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা- এগুলো আমরা করিনি। তার ফলাফল আজকে জাতিকে পেতে হচ্ছে।
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু এই চেতনাগত জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। এটাই আমাদের দুর্বলতা। এই দুর্বলতা যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কাটাতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। তিনি বলেন, বাঙালির মধ্যে চেতনাগত যে উন্নতি দরকার, তার জন্য যেভাবে কাজ করা দরকার, সেভাবে করা হয়নি। হ্যা, ভাসা ভাসা কিছু কাজ হয়েছে, এটা ঠিক। যেমন ধরুন, জয় বাংলা কনসার্ট করা হয়েছে। একেকটা স্টেডিয়ামে ১০ থেকে ২০ হাজার তরুণকে গান শোনানো হয়েছে। আগ্রহ ভরে তারা গান শুনেছে, নেচেছে। আনন্দ শেষে গায়ের জামা কাঁধে নিয়ে তারা বাড়িতে ফিরে গেছে। সেখানে চেতনাগত উন্নতির কী কোনো বার্তা আছে? যদি না থাকে, তাহলে এত টাকা খরচ করে সেই কনসার্ট করে লাভ কী!
এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, একটা কনসার্টের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলো; কিন্তু গ্রামগঞ্জে আমাদের যে মৌলিক সংস্কৃতি, লোকসংগীত, গণসংগীত, পঞ্চকবির গান, যাত্রা, পথ নাটক, জারি-সারি, বাউল, লালন সংগীত সেগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য গ্রামগঞ্জ থেকে সেগুলো খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণ দেয়া- সেই কাজগুলি করা হয়নি। তাহলে সাংস্কৃতিক বিকাশ আমাদের মধ্যে কীভাবে হবে? সাংস্কৃতিক ও চেতনাগত জাগরণ হবে কীভাবে? উপজেলা পর্যায়ে কোনো মুক্তমঞ্চ নেই। তাহলে সাংস্কৃতিক চর্চা করবেন কীভাবে? অনুষ্ঠানই বা করবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো দুটি। একটি হলো সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধা, আরেকটি হলো আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। কিন্তু তিনি একা হলে তো চলবে না। আজ পর্যন্ত সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। আমাদের সবচেয়ে খারাপ লাগে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও কেনো এরকম হবে?
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কুদ্দুছ বলেন, অনুদান নির্ভর সংস্কৃতি বাদ দিয়ে এখানে বিনিয়োগ করতে হবে। বাস্তব পরিস্থিতিতে জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সংস্কৃতির বিকাশের জন্য কী কী করা দরকার, সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ণ করলেই একমাত্র সম্ভব। এছাড়া সম্ভব নয়।