আল-শাহরিয়ার শাওন
গরম ভাত

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাত গভীর। পৃথিবী যেন নিজের শ্বাস ধরে আছে। আকাশ এত নিচে নেমে এসেছে যে মনে হয়, হাত বাড়ালেই কুয়াশার ভারী পর্দা ছুঁয়ে দেয়া যাবে। বাতাসে জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা, যেন প্রতিটি শ্বাসে শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। রাস্তার ধারে ছায়া-ছায়া ছোট ঝুপড়িগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, এরা কুয়াশার মাঝে হারিয়ে যাওয়া কোনো বিস্মৃত স্বপ্ন।
ঝুপড়ির ভেতরে শীত ঢুকেছে চাঁদের আলোর মতো। বোনা কাঁথার টুকরো কিংবা ছেঁড়া শাড়ির টুকরায় শীতের প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা যেন এক অসম যুদ্ধ। এক কোণে বসে আছে একজন মা। তার মুখের কোণে জমে থাকা ক্লান্তির ছাপ বলছে, জীবন তার কাছে সহজ ছিল না। তবুও সে হাল ছাড়েনি। একরত্তি শিশুটিকে একটি পুরনো চাদরের ভাঁজে জড়িয়ে নিজের গায়ে শক্তি জড়ো করে বসে আছে।
শিশুটি ঘুমাচ্ছে না, তার ছোট ছোট চোখগুলো অন্ধকারে ঘরের জীর্ণ পর্দাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। শীতে তার ছোট শরীর কেঁপে উঠছে বারবার। একপাশে পড়ে আছে একটি থালা, যার মধ্যে ঠাণ্ডা ভাত আর আলু ভর্তা। শিশুটি থালার দিকে তাকিয়ে মনে মনে কিছু ভাবছে। ভাতের ধূসর স্তূপ তার মনে এনে দেয় এক কল্পনার জগৎ- ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, যে ভাত ছুঁয়ে দিলে গায়ের ঠাণ্ডা গলে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সে জানে, এই শীতের রাতে গরম ভাত পাওয়া তাদের ভাগ্যের চেয়ে অনেক দূরে।
ঝুপড়ির বাইরে ঘন কুয়াশার মধ্যে একটা রিকশার আওয়াজ ভেসে আসছে। পুরুষটি সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ফিরে আসছে, পকেট প্রায় শূন্য। তার সামনে অপেক্ষা করছে আরো এক রাত্রির সংগ্রাম।
ঘরের ভেতরে শিশুটি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের কল্পনায় ডুবে আছে, আর বাইরে, পুরো পৃথিবী যেন কুয়াশার চাদরে মুড়ে গেছে, আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে তাদের দুঃখ-কষ্টের গল্প।
শীত এখন আরো তীব্র। ঝুপড়ির ছাউনি দিয়ে কুয়াশা ঢুকে পড়েছে ভেতরে। ঘরের চারপাশে জমে থাকা নিস্তব্ধতা যেন ধীর লয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক ধরনের অচেনা ভয়। অন্ধকার রাতের মধ্যে এই পরিবারটি বেঁচে থাকার যে ক্ষুদ্র সংগ্রাম করছে, তা বড় কোনো নাটকের দৃশ্যের মতো, যেখানে পর্দার ওপাশে কেউ নেই। কেউ দেখতে চায় না এসব।
পুরুষটি ফিরে এসেছে। তার গায়ের গরম শ্বাসেও শীতের তীব্রতা রয়ে গেছে। মুখে পরিশ্রমের ছাপ আর চোখে হতাশার কণিকা, যা তিনি ঢাকার চেষ্টা করছেন। তিনি বোঝেন, যা আছে তা দিয়ে সকাল অবধি টিকে থাকতে হবে।
শিশুটির মা ভাতের প্লেটটি একবার তাকিয়ে দেখে। ঠাণ্ডা ভাত, যা এখন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। ছোট হাত দুটো দিয়ে শিশুটি ভাতের মুঠো ধরে কাঁপতে কাঁপতে মুখে তুলে নেয়। তার গায়ে ছেঁড়া চাদর, তবে তার মনের মধ্যে জ¦লছে গরম ভাতের সুগন্ধ। শিশুটির চোখে এখন কল্পনার এক অদ্ভুত দুনিয়া। সে দেখে, টেবিল ভর্তি ধোঁয়া ওঠা খাবার। গরম ভাত, মাখন দিয়ে ছোঁয়া আলু ভর্তা। তার ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া আঙুলগুলোও যেন সেই স্বপ্নে উষ্ণ হয়ে ওঠে।
বাইরে কুয়াশা আরো গাঢ় হয়েছে। শীত যেন পাখির মতো ঝুপড়ির ওপরে বসে আছে। পুরুষটি তার গায়ের চাদর স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। যেন এটি তার নীরব অনুরোধ- যা আছে, তাই দিয়েই বাঁচার চেষ্টা করো। তিনি জানেন, তার সামান্য আয়ে এই শীতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হবে। এটাই তাদের নিয়তি। এই রাতের মতো তাদের জীবনও যেন এক অন্তহীন দীর্ঘ শীতের গল্প।
শিশুটি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখে স্বপ্নের হাসি। হয়তো সে ধোঁয়া ওঠা ভাতের স্বপ্ন দেখছে। হয়তো সে এমন এক দুনিয়ার কল্পনায় মগ্ন, যেখানে কোনো শীত নেই, কোনো অভাব নেই।
ঝুপড়ির ভেতরে নীরবতা নেমে এসেছে। সেই নীরবতা শুধু শীতের নয়, তা জীবনেরও। ভেতরের আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে, আর বাইরে কুয়াশা যেন ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে পুরো পৃথিবীকে। পৃথিবী চলবে, কিন্তু এই গল্প এখানেই থেমে যাবে প্রতিবার।
য় বামনী, রায়পুর, ল²ীপুর