হেলাল হাফিজ
কবিতার নীল আকাশে ধ্রæবতারা

নাজরাতুন নাঈম ইসলাম
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জনপ্রিয়তা আনন্দের আবার কখনো জনপ্রিয়তাই শিল্পীর ওপর চাপিয়ে দেয় বিশাল দায়বদ্ধতা। আধুনিক রোমান্টিক কবি হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ¦লে’ বইটি যখন প্রথম বইমেলায় আসে তখন কাব্যপ্রেমিকদের তুমুল উচ্ছ¡াসে নন্দিত হয় বইটি, পরবর্তীতে পর পর তেত্রিশটির বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং প্রত্যেকবার পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
কবি শেলী বলেছিলেন, ঙঁৎ ংবিবঃবংঃ ংড়হমং ধৎব ঃযড়ংব ঃযধঃ ঃবষষ ড়ভ ংধফফবংঃ ঃযড়ঁমযঃ. কবি হেলাল হাফিজ ও তার কাব্যের আড়ালে থাকা কষ্ট আর বেদনাকেই বারবার স্মরণ করেছেন। কবি প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ নিয়ে বিস্ময়কর চমৎকার পঙ্ক্তিমালা রচনা করেছেন।
‘প্রেম
মূলত মিলনে মলিন হয়
বিরহে উজ্জ্বল’
এটা কবি হেলাল হাফিজের কথা।
প্রেমের চেয়ে বিরহবেদনা, অপ্রাপ্তি হলো শিল্প সৃষ্টির বিমূর্ত চেতনা। লেখক হেলাল হাফিজ তার জনপ্রিয় মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ¦লে’ প্রকাশের পর দীর্ঘ কয়েক বছর আর কোনো কবিতার বই প্রকাশ করেননি। কবিতা লিখেছেন কিন্তু বই আকারে প্রকাশ করেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, কোনো অভিমান নয় এক ধরনের সীমাবদ্ধতা তিনি বোধ করতেন। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির প্রতিটি কবিতা যেন হৃদয়ের গভীরতম স্তরের অনুভূতির অনুরণিত আর্তনাদ। কবি হেলাল হাফিজ স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলেন তখন হেলাল হাফিজের মনে হলো তার একাকিত্বের যন্ত্রণা খেলাধুলা ঘুচিয়ে দিতে পারছে না। তিনি আরো বেশি কবিতা লিখতে শুরু করলেন, দেখলেন এই সৃজনশীলতা তার বেদনাকে অনেক প্রশমিত করছে। তার কবিতায় আমরা কষ্ট নিয়ে পাই অনেক উক্তি। তিনি লিখেছেন-
‘কষ্ট নেবে কষ্ট।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,’
কবি হেলাল হাফিজ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তার জীবন ছিল উত্তাল সময়ের স্রোতের মতো কল্লোলময়। প্রেম ছিল, দ্রোহ ছিল আর বিভিন্ন আন্দোলনে কবির কবিতা ছিল শব্দসৈনিক। কবি লিখেছেন-
‘মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে এ রকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই, উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ শুধু যদি নারীকে সাজাই।’
শুধু নারী নয় দেশ, সমাজ, নিজের জন্মমাটি, নেত্রকোনার সেই ছোট গ্রাম, নদী, বৃক্ষ ছিল কবির কবিতার অনুষঙ্গ। যৌবনে কবি প্রেমে পড়লেন হেলেন নামের এক তরুণীর প্রতি। সেই প্রেম আর পরিণতি পেল না, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল। কবি তীব্র বেদনায় স্তব্ধ হয়ে পড়লেন, কয়েকদিন পর অজান্তেই লিখলেন চরণের পর চরণ, যা হয়ে উঠল কালজয়ী প্রেমের কাব্য। গভীর বেদনায় কবি লিখলেন ‘তুমি জান, আমি জানি, পাড়া প্রতিবেশীরা জানে পাইনি তোমাকে, কিন্তু তুমি আছ এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।’
কবি বলেছেন বিপ্লবী হতে হলে আগে প্রেমিক হতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যাতে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে সেদিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। সকল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, কবি যখন সশস্ত্র যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন দেখেছিলেন পূর্ববাংলার মানুষ দেখতে চায় স্বাধীনতা, দেশেপ্রেমে বাংলার স্বাধীনতাকামী কৃষক, মজুর, ছাত্ররা দুর্নিবার। তার বিপ্লবী কবিতা উদ্বেলিত করেছিল বাংলার ছাত্রসহ আপামর জনগণকে। তবে একটি সময় কবি বলেছিলেন যদিও তিনি বিপ্লবী কবিতা রচনা করেছেন কিন্তু তিনি শান্তির পূজারি, তিনি যুদ্ধ হানাহানি নৈরাজ্যমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব দেখতে চান। কবি হেলাল হাফিজ আসলে নিভৃতচারী শান্তিপ্রিয় প্রেমের কবি। কবি একটি সময় বলেছেন, ‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’। শিশুকালে মাতৃবিয়োগ, স্কুল শিক্ষিকা সবিতা সেনের স্মৃতি, প্রিয়তমা হেলেনের অন্যত্র বিয়ে, বাবার মৃত্যু এবং আরো অনেক বিয়োগব্যথা, অপ্রাপ্তি কবির বাইরের জগৎকে সীমিত করলেও অন্তরের অনুভবকে করেছে ঋদ্ধ, শিল্পময়। কবি বলেছেন, তিনি বিত্ত-বৈভবের চেয়ে মানুষ জমাতে চেয়েছেন, তার কবিতার প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ সেটা তিনি উপভোগ করতে চেয়েছেন। কবির যাপিত জীবন নির্জনে কাটলেও তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, আর এটাকেই তিনি সৌভাগ্য হিসেবে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
জীবনের অনেকটা সময় কবি ছিলেন গৃহবিবাগী, উদাস পথিক, সারাজীবন কবিতা লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রেমের প্রত্যাখ্যান, বেদনা, বিরহ, মানুষের উপেক্ষার জন্য তিনি কবি হতে পেরেছেন। কবি মনে করেন দুঃখ, বিরহ হলো শিল্পের প্রেরণা। সুখ নয় অপ্রাপ্তি, অসফলতা, বিরহ মানুষকে প্রতিমুহূর্তে কাঁদায়, আর এই কান্নার তরঙ্গ বেহালার করুণ সুরের মূর্ছনার মতো বাজে কবিতায়। কবি হেলাল হাফিজের অন্তর্গত জীবন ছিল শূন্যতায় ভরা। বেশির ভাগ সময় পরিবারহীন একা জীবন কাটিয়েছেন। আর একাকিত্ব মানে নয় জনবান্ধবহীনতা। অনেক সময় অনেক মানুষের ভিড়ে থেকেও, বিশেষ সম্পর্কের মাঝে থেকেও ভেতরে ভেতরে যে কেউ একাকিত্বে ভোগতে পারে। কবি হেলাল হাফিজের চারপাশে ছিলেন ভক্ত-অনুরাগীরা, কিন্তু তারপরও ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু তিনি নিজেই একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন, প্রেমের স্পর্শ তিনি চেয়েছিলেন, সংসারও চেয়েছিলেন; কিন্তু সংসারী হওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রেম অনেকবার আসক্ত করলেও, চলার পথে বিশেষ মোহ, ভালোবাসা, মুগ্ধতা তৈরি হলেও কোনো সম্পর্ক শেষ অবধি পরিণতি পায়নি, বৈবাহিক সম্পর্ক পর্যন্ত যায়নি। জীবনের এই নিঃসঙ্গতাকে কবি তার কবিতায় বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি বলেছেন-
‘জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রæপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গৃহস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস!’
কবি তার কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কবির নির্বাচিত মৌলিক কবিতার বই পর পর কয়েকটি বইমেলায় ছিল সর্বোচ্চ পাঠককৃত জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই সরল, বন্ধুপ্রিয়, আড্ডাপ্রিয়, নম্রভাষী একজন মানুষ। জীবনের গোধূলি বেলায় কবি চেয়েছিলেন আত্মজীবনী লিখতে এবং আরো কিছু কবিতা লিখতে। আধুনিক কবি, জননন্দিত কবি লিখতে লিখতেই চলে গেলেন ওপারে। অন্যভুবনে পরলোক গমন করলেন। শেষ সময়ে কবি ছিলেন নিঃসঙ্গ। বেদনার কবি, ভালোবাসার কবির কথা এখনো প্রতিধ্বনিত হয়, কবির লেখা সেই চরণে ‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।’ আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে প্রতিভাবান কবি হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে আধুনিক কবি হেলাল হাফিজের নাম, কবিতার নীল আকাশে ধ্রæবতারা হয়ে উজ্জ্বল্য ছড়াবেন জননন্দিত কবি হেলাল হাফিজ।