হঠাৎ কেন উত্তপ্ত প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়?

অনামিকা রায়
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ০৪:৪৬ পিএম
টানা চার দিন ধরে উত্তপ্ত সচিবালয়। বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল ও স্লোগানে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে প্রশাসনিক কাজের এই মূল কেন্দ্র। গেল কয়েকদিনের মত আজও বিক্ষোভ করছেন শত শত কর্মকর্তা–কর্মচারী। চলমান এই আন্দোলনে কার্যত অচল সরকারি সব কার্যক্রম।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, ‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। তা না-হলে কাজে ফিরবেন না তারা। এছাড়াও অধ্যাদেশ প্রত্যাহার না হলে সচিবালয় অচল করার হুমকিও আন্দোলনকারীদের। আজও শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী সচিবালয়ের প্রধান গেট বন্ধ করে দিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছেন। প্রবেশের অন্য গেটগুলোও বন্ধ। এতে কার্যত অচল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রটি।
মূলত, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নতুন এ অধ্যাদেশের খসড়ায় যুক্ত বেশ কিছু আইনকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করেছেন তারা।
অভিযোগ উঠেছে, সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু ‘নিবর্তনমূলক ধারা’ সংযোজন করে অধ্যাদেশের খসড়াটি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সহজেই শাস্তি, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়াটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও দাবি আন্দোলনকারীদের।
অধ্যাদেশে ৪ ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধের জন্য বিভাগীয় মামলা ছাড়া কেবল কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করার বিধান রাখা হয়েছে। শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কর্মে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য, উসকানির জন্য, কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির বিধান এতে রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এর বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই। গেল ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আন্দোলনের পেছনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অস্থির প্রশাসনিক বাস্তবতাও বিদ্যমান। এর আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য, পদোন্নতি নীতিমালা সংস্কার এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রতিবাদে কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি দেখা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তব পদক্ষেপের অভাবে আন্দোলন ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত সচিব থেকে অফিস সহায়ক; সব স্তরের কর্মীরা এই আন্দোলনে যুক্ত হন। এতে সচিবালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত, প্রশাসনিক অচলাবস্থার আশঙ্কাজনক।
বিশ্লেষকরা এ-ও মনে করছেন, শুধু প্রশাসনিক দাবি-দাওয়া নয়; এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক অসন্তোষও রয়েছে। দ্রুত সমাধান না এলে প্রশাসনিক অচলাবস্থা আরও বাড়তে পারে। এর পেছনে রাজনৈতিক বার্তাও লুকিয়ে থাকতে পারে। আর আন্দোলনের তীব্রতা ও বিস্তৃতি সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে প্রশাসনের বড় এই অংশটি সরকারের ওপর আস্থা হারালে, শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার একদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে চাইছে, অন্যদিকে প্রশাসনের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কিছু ‘প্রণোদনামূলক’ নীতিমালাও বিবেচনা করছে। তবে এখনই সমাধানে না এলে সচিবালয় কেন্দ্রিক এই অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক শাসনব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।