উত্তরায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলেন বরখাস্ত সেনা ও পুলিশ সদস্য

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ০৬:৪২ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
রাজধানীর উত্তরায় গত ১৪ জুন (শনিবার) র্যাব পরিচয়ে একদল চক্র নগদ অর্থ সংগ্রহকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ছিনতাই করে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ছিনতাইকৃত অর্থের মধ্যে ২২ লাখ ১০ হাজার ৭৮০ টাকা, ব্যাংকে জমা থাকা আরো ১২ লাখ টাকা এবং একটি হায়েস মাইক্রোবাস।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন— মো. হাসান (৩৫), গোলাম মোস্তফা ওরফে শাহিন (৫০), শেখ জালাল উদ্দিন ওরফে রবিউল (৪৩), ইমদাদুল শরীফ (২৮) এবং সাইফুল ইসলাম ওরফে শিপন (২৭)।
ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত হায়েস গাড়িটির নম্বর থেকে সূত্র ধরে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও উত্তরা পশ্চিম থানা যৌথভাবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বুধবার (১৮ জুন) চক্রটির পাঁচ সদস্যকে আটক করে।
পুলিশ বলছে, মূলত এই ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্বে দিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত এক সার্জেন্ট ও চাকরিচ্যুত এক পুলিশ কনস্টেবল। ছিনতাইয়ের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী গোলাম মোস্তফা ওরফে শাহিন পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল। তার বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ নানা অপরাধে ১৭টি মামলা রয়েছে। চক্রের অন্যতম সহযোগী সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সার্জেন্ট শেখ জালাল উদ্দিন ওরফে রবিউল। আরো অন্তত তিনজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম জানান, গত ১৪ জুন সকাল ৮ টা ৫৫ মিনিটের দিকে নগদের ডিস্ট্রিবিউটর আব্দুল খালেক নয়ন তার উত্তরার ১২ নম্বর রোডের ৩৭ নম্বর বাসা থেকে প্রতিষ্ঠানের চারজন কর্মচারীসহ চারটি ব্যাগে এক কোটি আট লাখ ১১ হাজার টাকা নিয়ে দুটি মোটরসাইকেলযোগে উত্তরার নগদের অফিসের উদ্দেশে রওনা হয়।
পথিমধ্যে উত্তরা ১২ ও ১৩ নম্বর রোডের সংযোগস্থলে একটি কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাস তাদের গতিরোধ করে। মাইক্রোবাস থেকে ‘র্যাব’ লেখা কালো কটি পরিহিত মুখে কালো কাপড় বাঁধা ৬/৭ জন অজ্ঞাত ব্যক্তি হাতে অস্ত্র নিয়ে নামে। তাদের কাছে আসতে দেখে নগদের টাকা বহনকারী কর্মচারীরা টাকার ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। তখন দুষ্কৃতকারীরা তাদের ধাওয়া করে চারটি ব্যাগে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের তিনজনকে মাইক্রোবাসে তুলে হাত-চোখ বেঁধে মারধর করে। ঘটনাস্থল থেকে একজন কর্মচারী পালাতে সক্ষম হন।
পরে ডাকাতরা তিনজনকে তুরাগ থানার ১৭ নম্বর সেক্টরের বৃন্দাবন এলাকায় ফেলে রেখে টাকা, দুটি অফিসিয়াল মোবাইল ফোন ও তিনটি ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় আব্দুর রহমানের অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়।
গতকাল বুধবার রাত পৌনে ২টায় খিলগাঁও থানা এলাকা থেকে মাইক্রোবাসের চালক মো. হাসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার হেফাজত হতে নকল একটি নেমপ্লেট ও নগদ আট হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। হাসানের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সবুজবাগ থানার মাদারটেক চৌরাস্তার স্বপন মিয়ার গ্যারেজ থেকে ডাকাতির ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়।
ডিবি উত্তরা বিভাগের একটি টিম ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে। পরে ডাকাত চক্রের মূলহোতা গোলাম মোস্তফা ঘরামী ওরফে শাহিনকে ঢাকার উত্তরা এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তার কাছ থেকে লুণ্ঠিত ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইমদাদুল শরীফকে আদাবর থানাধীন বায়তুল আমান হাউজিং এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার নিকট হতে লুণ্ঠিত ৮ লাখ ৪ হাজার ৭৮০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তার শাহিন ও শরীফের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট শেখ জালাল উদ্দিনকে একই দিন রাতে সবুজবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার নিকট হতে নগদ ৬৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার জালাল নিজেকে ক্যাপ্টেন জালাল হিসেবে পরিচয় প্রদান করে। জালাল ঘটনার পরদিন লুণ্ঠিত ১২ লাখ টাকা ঢাকা ব্যাংকের নিজ নামীয় অ্যাকাউন্টে জমা করে। ওই টাকা জব্দের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
জালালের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডাকাত চক্রের অপর সদস্য সাইফুল ইসলাম ওরফে শিপনকে গতকাল বুধবার রাতে এয়ারপোর্ট রেল স্টেশন এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের হেফাজত হতে র্যাব ও পুলিশের নকল আইডি কার্ড, লাঠি, সিগনাল লাইট, সেনাবাহিনীর লোগো সম্বলিত মানিব্যাগ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মুহিদুল ইসলাম আরও জানান, ডাকাত দলের দলনেতা মোস্তফা ওরফে শাহিন একজন চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল। তার বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ অন্তত ১৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯৯৫ সালে রমনায় অস্ত্রসহ ধরা পড়ার পর চাকরি হারায় শাহিন।
তার গড়া চক্রের প্রধান সহযোগী শেখ মো. জালাল উদ্দিন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সার্জেন্ট। সে ক্যাপ্টেন পরিচয় দিয়ে চলতো। দুজনের নেতৃত্বেই এই দলটি দীর্ঘদিন ধরে র্যাব ও পুলিশের পরিচয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করে আসছে মর্মে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। এ ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদে গ্রেপ্তারসহ অবশিষ্ট টাকা উদ্ধারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে উত্তরা বিভাগের ডিসি বলেন, আমরা নগদ কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর অফিসের একাধিক কর্মচারীকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা কারও যোগসাজশ বা তথ্য দিয়ে ডাকাত দলকে সহযোগিতা করার তথ্য পাইনি। যে দুই পার্টনারের টাকা তারাও এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সন্দেহের কথা জানাননি। তবে আমরা তদন্ত করছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে এখনো সাসপেনশন আছে।