ব্যবসার সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করাই আমার লক্ষ্য
আতিকুর রহমান, চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআই বৈষম্য বিরোধী সংস্কার পরিষদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:৪২ পিএম

এফবিসিসিআই বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান। ছবি: ভোরের কাগজ
দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) নির্বাচন ঘিরে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনী উৎসবের আমেজ বইছে। এবারের নির্বাচনের পরিচালক পদপ্রার্থী আতিকুর রহমান। বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারিং এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এ ব্যবসায়ী জুট সেক্টর ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের জন্য বৈষম্য বিরোধী সংস্কার পরিষদ (এফবিসিসিআই) মিডিয়া ও লিয়াজোঁ কমিটির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান এফবিসিসিআই নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মরিয়ম সেঁজুতি-
ভোরের কাগজ: এফবিসিসিআই নির্বাচনকে বার বার পেছানো হচ্ছে, মামলা হয়েছে। আপনি কি মনে করেন এবারের নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে?
আতিকুর রহমান: ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাড়ে ৪ কোটি ব্যবসায়ী জড়িত। বিগত দিনগুলোতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণই ত্রুটিপূর্ণ। গত ৫ আগস্ট একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। বিগত দিনের নেতারা একটি বিশেষ মহলের আজ্ঞাবহ ছিলেন, ব্যবসায়ীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন পদক্ষেপ নেননি। ফলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। আমি মনে করি, অবশ্যই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন বোর্ড, আপিল বোর্ড, এফবিসিসিআই প্রশাসন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সরকার- সবার কাছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি থাকবে। আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ নেতৃত্ব আসুক।
ভোরের কাগজ : বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক আপনি। পরিচালক নির্বাচিত হলে এফবিসিসিআইয়ের কোন বিষয়ে সংস্কার আনবেন?
আতিকুর রহমান: ১৯৯৪ সালের পর আর বাণিজ্যবিধি প্রনয়ণ হয়নি। বার বার এ বিধির উপরে হাত দিয়ে এফবিসিসিআইকে একটি নমিনেটেট ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, এফবিসিসিআইতে পরিচালক ছিল মোট ৮০ জন। সেখানে চেম্বারের ১৭ জন এবং এসোসিয়েশনের ১৭ জন নমিনেটেড হয়ে আসতে হবে। বাকি ২৩ এবং ২৩ মোট ৪৬ জন ছিল নির্বাচিত বডি। কিন্তু চেম্বার গ্রুপে তখনো নির্বাচন হতো না। সেখানেও ২৩ জন। কারণ মোট চেম্বার ৮০ টি। প্রায় ৬০ শতাংশ তাদের থেকে পরিচালক হয়ে যায়। ফলে সেখানে একটি ডামি তৈরি করে নিজেদের পছন্দমতো সাজিয়ে নিতো। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের আশা আকাঙ্খা সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। আমরা মনে করি, এফবিসিসিআইয়ের একটি নিজস্ব কাঠামো থাকবে। এফবিসিসিআই একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে। এ বিপর্যয় থেকে উত্তোরণ ঘটাতে হলে এর বিধিমালা প্রনয়ণ করতে হবে। ২০২২ সালে বানিজ্য সংগঠন আইন পাশ হয়। তারপরেও বিধিটা হয়নি। কারণ একটি আইন যখন হয়, আইনের বিভিন্ন দিকগুলো দেখে তবেই বিধি তৈরি হয়।
ফলে পরিবর্তন পরবর্তী সময়ে আমরা বাণিজ্য সংগঠন বিধি প্রণয়নের জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি এবং ৮টি বিষয়ে সুপারিশ দিয়েছি। দাবির মধ্যে প্রথমত, আমরা গুরুত্ব দিয়েছি প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে সরাসরি নির্বাচন। দ্বিতীয়ত, আমরা বলেছি, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসন ছোট করে আনতে হবে। এতো মাথাভারি লোক প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- চেম্বার গ্রুপ থেকে ১৫ জন পরিচালক, এসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে ১৫ জন, একজন প্রেসডেন্ট, একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ ৩৪ জন। এছাড়া ৬ এবং ৬ মোট ১২ জন চেম্বার ও এসোসিয়েশন থেকে আসতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৪৬ জনের এ প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন। আরেকটি আমাদের দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট যদি এসোসিয়েশন থেকে হয় তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট অবশ্যই চেম্বার থেকে হবে।
এখন যখন বিধি পাশ হয়েছে অনেকেরই যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে। ফলে এরা বিভিন্নভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। আমার বিশ্বাস সরকার এবং ব্যবসায়ী সমাজ এটা মেনে নিবে না। আমরা এখান থেকে উত্তোরণ ঘটাবো এবং নির্বাচনের মাধ্যমে এফবিসিসিআইকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধির হাতে তুলে দিতে পারবো আশা করছি।
ভোরের কাগজ: ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই। নির্বাচন পরবর্তী দেশের স্থবির অর্থনীতিকে কতটা প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?
আতিকুর রহমান: সারাবিশ্বেই ব্যবসার পরিস্থিতিতে একটি মন্দাভাব যাচ্ছে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক এবং আভ্যন্তরীণ দুইভাবেই মন্দার মধ্যে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের যে নেগোসিয়েশন সেখানে এফবিসিসিআইয়ের কোন প্রতিনিধি যেতে পারেনি। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলে এটা হতো না। তাই যত দ্রুত নির্বাচন হবে, দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ততই মঙ্গলজনক হবে। নির্বাচিত কমিটির একটি দায়বদ্ধতা থাকবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে। তাই আগামী নভেম্বরের মধ্যে ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনের নির্বাচন হয়ে গেলে, ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির গতি সঞ্চার হবে এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ভোরের কাগজ: সংস্কারপন্থী এফবিসিসিআইতে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দিবেন?
আতিকুর রহমান: এফবিসিসিআইয়ের বাইরেও আমি বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেলস অব বাংলাদেশ (আটাবের) যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারাস এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি, জুট সেক্টর ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। আমি মনে করি, আমাদের খাতভিত্তিক দায়িত্ব থাকে, যেমন- আমি জুট এবং এভিয়েশন খাতকে রিপ্রেজেন্ট করি। বাংলাদেশে পাট উৎপাদন করে আমরা পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের বিনিয়োগ হচ্ছে এক বিলিয়ন, কিন্তু এখান থেকে ১০০ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এসব জায়গাগুলোতে কাজ করতে চাই। পাট খাত নিয়ে একটি বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সারাবিশ্বে পরিবেশবাদিরা প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের পরিবেশ উপদেষ্টাও এ বিষয়ে জিরো টরারেন্স অবস্থায় রয়েছে। আমি মনে করি, সব খাতেই কাজ করতে হবে- এমন কোন কথা নেই।
পরিকল্পিতভাবে আমাদের পাট মিলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একটি হতাশার কথা হচ্ছে, আমাদের এখানে মিল বন্ধ হচ্ছে কিন্তু আমাদের এখান থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন মিল তৈরি হচ্ছে। আমাদের কাঁচা পাট সেখানে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে তারা ডাইভারসিফিকেশন করে প্রতি মাসে ৮-১০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করে। তাই আমি মনে করি, এখানে যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি। আমাদের সরকার যদি এ খাতে একটু মনোযোগ দেয় তাহলে পাট খাতকে আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবো।
২০২৬ সালে আমরা এলডিসি গ্রাজুয়েশন হবো। সে সময়ে আমাদের রপ্তানিতে অনেক বাধ্য বাধকতা চলে আসবে। এজন্য আমাদের বিকল্প সৃষ্টি করতে হবে। এ বিকল্প হচ্ছে, গতানুগতিক ব্যবসার বাইরে যেতে হবে। যেমন- পাটকাঠিকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চূর্ণ করে আমরা চারকোল করি। এই চারকোল আমরা রপ্তানি করি। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, এ চারকোল থেকে আমরা ফটোকপি, কম্পিউটারের কালি, এক্টিভেটেড কার্বন করতে পারলে এখান থেকে একটি বিশাল বৈদেশিক মুদ্রা আসবে।
চারকোল খাতে ৮০ শতাংশই নারী কাজ করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ নারী। কিন্তু লিডারশীপে নারীদের অবস্থান খুবই সামান্য, মাত্র ১২ শতাংশ। একটি দেশ যদি উন্নয়ণশীল দেশে পরিণত করতে হয় তবে নারী নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে পথ চলতে হবে। আমি মনে করি, নারীকে যত বেশি শক্তিশালী করবো তত বেশি দেশের উন্নয়ণ করা সম্ভব।
আগামীতে এফবিসিসিআই হবে একটি সমৃদ্ধ সংগঠন, অর্থনীতির একটি তথ্যভান্ডার। একসময় পাটের উপরে নির্ভরশীল ছিলাম, বর্তমানে রপ্তানির প্রায় পুরোটাই গার্মেন্টস খাতের উপর নির্ভরশীল। পোশাকের গুরুত্ব সবসময় থাকবে না। তার মানে অমাাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। আমি এফবিসিসিআাইয়ের পরিচালক নির্বাচিত হলে বড় ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব কম দিয়ে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি খাতকে গুরুত্ব দিবো। কারণ জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশই ভূমিকা পালন করে এসএমই খাত। অথচ আমরা এ খাতকে হেলায় হারাচ্ছি।
আইসিটিতে এখনো আমরা কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের অনেক সম্ভাবনাময় একটি খাত লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং। এ খাতে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমাদের অনেক অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি হয়। সেখানে সরকার মনোযোগী হলে রপ্তানিতে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
এক সময় চা এবং পাট আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত ছিল। এখন এর অবস্থান খুবই খারাপ। একসময়ের উজ্জল রপ্তানিকারক খাত ছিল চামড়া। কিন্তু বর্তমানে চামড়া খাতে ধ্বস নেমেছে। কোনোভাবেই তারা উঠতে পারছে না। এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে যারাই আসুক তাদের এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে এবং ব্যবসাকে একজায়গায় আটকে না রেখে এটাকে প্রসারিত করতে হবে। নতুন নতুন ডাইমেনশন নিয়ে আসতে হবে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজাইনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
ডিজাইনিংয়ের জায়গাতেও আমাদের অনেক সমস্যা। আমাদের ব্যবসার কোন খাতেই সঠিক কোন গবেষণার ব্যবস্থা নেই। গবেষণা না হলে কোন খাতেরই উন্নয়ণ সম্ভব নয়। এই জায়গাতেও অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। চায়নারা প্রত্যেকটা ব্যবসার ক্ষেত্রেই গবেষণাকে অনেক গুরুত্ব দেয়। আমাদের একটি ভালো টেস্টিং ল্যাব নেই। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোও সক্ষম নয়। আমি পরিচালক নির্বাচিত হলে প্রথমেই পাঁচটি খাতকে টার্গেট করে সেখানে ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান করে উন্নয়ণ ঘটানোর চেষ্টা করবো। এ প্রক্রিয়া যেন চলমান থাকে সেভাবেই কাজগুলো নিয়ে এগিয়ে যাবো। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতেও সুফল আসবে, আমাদের আর পরনির্ভরশীল হতে হবে না।