ইতিহাস, গুরুত্ব এবং জাতীয় স্লোগানে পরিণত হওয়া
যেভাবে হয়ে ওঠে 'জয় বাংলা' জনগণের স্লোগান

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৭ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
'জয় বাংলা' কখনোই শুধু একটি রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, বরং এটি ছিল বাঙালির ঐতিহ্য, চেতনা, দেশপ্রেম এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। ‘বাংলার জয়’ শব্দগুলো বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন হিসেবে উঠে এসেছে, বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসকদের নির্মম শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের লড়াইয়ে।
এ স্লোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে। ‘জয় বাংলা’ ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে জনসাধারণের স্লোগানে পরিণত হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে শক্তিশালী করেছে। ১৯২২ সালে ভারতের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতায় এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর জেলে থাকার সময় এটি লিখেছিলেন। কবিতাটির মূল বিষয় ছিল ঔপনিবেশিক শাসন, বিদেশি নিপীড়ন এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। পঞ্চম স্তবকে 'জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র' লেখা ছিল, যা পরবর্তীতে এই স্লোগানটির সাথে যুক্ত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ বিরোধী বীর পূর্ণচন্দ্র দাসকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। পূর্ণচন্দ্র দাস মাদারীপুরের একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন এবং নজরুলের সহবন্দী ছিলেন।
১৯২৪ সালে কবি নজরুল তার কাব্যগ্রন্থ *ভাঙার গান* এ এটি প্রকাশ করেন। এরপর কবি নজরুল ১৯৪২ সালের ৩ বৈশাখ, ১৩৪৯ বাংলা তার 'বাঙালির বাংলা' প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "বাংলা বাঙালির হক, বাংলার জয় হক, বাঙালির জয় হক," যা 'জয় বাংলা' স্লোগানের আরো বিস্তার ঘটায়।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিলেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অধীনে বাঙালির স্বাধীনতা অধরা থাকায় 'জয় বাংলা' স্লোগানটি পুনরুত্থিত হয়। ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠিত হলে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় 'জয় বাংলা' স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয়। ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ এই স্লোগানটি দেন। তার এই স্লোগান দেয়ার পটভূমিতে ছিল ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরবর্তী মুক্তি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের সফরের অভিজ্ঞতা।
এরপর ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই স্লোগান আরেকবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে এই স্লোগান শোনা যায়। ৩ মার্চ, ১৯৭১ সালে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ঘোষণা করে এবং পরবর্তীতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ ‘জয় বাংলা’ দিয়ে শেষ করেন।
৭ মার্চের ভাষণের পর 'জয় বাংলা' স্লোগানটি দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান স্লোগান হয়ে ওঠে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার ভাষণ শেষ করেন 'জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ' বলে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং ২০২২ সালের ২ মার্চ, আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করে।
এভাবে 'জয় বাংলা' শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয়, বরং বাঙালির স্বাধীনতা, ঐক্য, এবং জাতীয় চেতনাকে প্রতিফলিত করার শক্তিশালী উপাদান হয়ে উঠেছে, যা দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।