যুক্তরাজ্যে ঢাকার ধনকুবেরদের গোপন সম্পত্তি বেচাকেনা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১১:৩১ এএম

ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জোরালো তদন্তের মুখে পড়া ঢাকার প্রভাবশালী ধনকুবেরদের একাংশ যুক্তরাজ্যে তাদের বিলাসবহুল সম্পত্তির মালিকানা গোপনে হস্তান্তর, বিক্রি কিংবা পুনঃঅর্থায়নের চেষ্টা করছেন। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি এমনই এক বিস্তৃত অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক বিতর্কিত অর্থপতি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শত শত বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন সামাল দিতে গিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদের সন্ধানে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা চাইছে।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ঢাকায় তদন্তাধীন অন্তত ২০টি প্রপার্টি-লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে এক বছরে। এর মধ্যে চারটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তিনটি বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তাঁর পরিবার, এবং তিনটি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাঁর পরিবারের নামে। এই লেনদেনগুলো বিক্রি, হস্তান্তর বা বন্ধক সংক্রান্ত।
আরো পড়ুন : ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন কী কাজ করবে, কেন কিছু দলের আপত্তি?
গত মে মাসে লন্ডনে সালমান এফ রহমান পরিবারের প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করে ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। এর কিছুদিন পরই সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৭ কোটি পাউন্ডের বেশি মূল্যের সম্পদ জব্দ হয়। তিনি ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে যুক্তরাজ্যে ৩০০-এর বেশি প্রপার্টি কিনেছিলেন বলে অভিযোগ।
লন্ডনের পাঁচতারকা হোটেল ডরচেস্টার। এর এক কক্ষের ভাড়া প্রতি রাতে ৮০০ পাউন্ডের বেশি। এই হোটেলকে ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান বলে নাও মনে হতে পারে। মেইফেয়ার এলাকার হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষগুলো জুনের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে আসা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের অস্থায়ী বাসস্থান হয়ে উঠেছিল।
এর নেতৃত্বে ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। লন্ডন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করে। ঢাকার তদন্তকারীরা জানান, অর্থ পাচারের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ খুঁজে বের করার জন্য তারা যুক্তরাজ্যের কাছে সহায়তা চেয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, আমরা যুক্তরাজ্যের সরকারকে আরো বেশি সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ দিতে অনুরোধ করছি, যাতে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের মালিকানাধীন নাইটসব্রিজের একটি চারতলা টাউন হাউস বিনামূল্যে এক রিয়েল এস্টেট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে পরবর্তীতে ৭৩ লাখ পাউন্ডের বেশি দামে এক অজ্ঞাত হিসাবরক্ষকের মালিকানাধীন কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়।
এই হিসাবরক্ষকের কোনো অনলাইন প্রোফাইল নেই এবং তিনি একাধিক কোম্পানির মালিক। বসুন্ধরা পরিবারের আরেক সদস্য সাফিয়াত সোবহানের মালিকানাধীন ৮০ লাখ পাউন্ড দামের একটি বাড়ি এবং সারে অঞ্চলের আরো দুটি প্রপার্টির লেনদেনও চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনের রিজেন্টস পার্কের পাশে ১ কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি জর্জিয়ান টাউন হাউস বিক্রি করেছেন। তবে তাঁর আইনজীবীরা দাবি করছেন, এই বিক্রির চুক্তি অভ্যুত্থানের আগেই হয়েছিল।
এইসব সন্দেহজনক লেনদেন সহজ করতে যুক্তরাজ্যের একাধিক আইনি সংস্থার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল।
গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জাসওয়াল জনস্টন ও মেরালি বিডল নামের ল ফার্মগুলো এসব বিতর্কিত সম্পত্তি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত। যদিও সংস্থাগুলো তাদের ভূমিকা অস্বীকার করেছে বা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
সালমান এফ রহমান পরিবারের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব মামলা করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য জো পাওয়েল বলেছেন, ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পাচার হওয়া অর্থ সহজেই লোপাট হয়ে যেতে পারে।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন যুক্তরাজ্যের কাছে অনুরোধ করেছেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রপার্টি মার্কেটের তৎপরতা বিবেচনায় আরো জব্দ অভিযান জোরদার করতে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালও বলছে, পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ছিল সন্দেহজনক লেনদেন পুলিশকে জানানো। তবে বাংলাদেশের দুদক এই বিষয়টিতে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।