×

জাতীয়

শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেয়া শিক্ষিকা মাহরীন শেষ মুহূর্তে যা বলেছিলেন

Icon

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১১:২৩ পিএম

শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেয়া শিক্ষিকা মাহরীন শেষ মুহূর্তে যা বলেছিলেন

ছবি: সংগৃহীত

‘ওই বাচ্চাগুলোও আমার বাচ্চা। ওদের মুখে আমার বাচ্চাগুলোর ছবি ভাসতেছিল। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে যতগুলা পারছি প্রায় ২০-২৫ জনকে টেনে বের করে দিছি। এরপরে কী হলো আমি জানি না’–– জীবনের শেষ মুহূর্তে এই কথাগুলো নিজের স্বামীকে বলেছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ভেন্টিলেশনে দেওয়ার পূর্ব মুর্হূতে স্বামী মনসুর হেলালের কাছে এই কথাগুলো বলে ক্ষমা চান নিহত এই শিক্ষিকা। রাজধানীর উত্তরায় গত সোমবার স্কুলটির যে ভবনে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেদিন সেই ভবনের গেটেই দাঁড়ানো ছিলেন তিনি।

কারণ ওই সময় বেলা একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ওই স্কুলের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটি হয়। দায়িত্ব পালনের জন্য সেখানেই ছিলেন শিক্ষিকা মাহরীন। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অভিভাবকের হাতে বুঝিয়ে দেয়া ছিল তার দায়িত্ব। ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলা ভার্সনের ক্লাস টু থেকে ক্লাস ফাইভের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন তিনি। ১৭ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে পদোন্নতি পেয়ে সবশেষে কো-অর্ডিনেটর হয়েছিলেন। 

এই শিক্ষিকার স্বামী মনসুর হেলাল বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি জানান, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে প্রথমেই স্ত্রীকে ফোন করেন। কিন্তু ফোনে না পেয়ে বড় ছেলেকে দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে মায়ের স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। পরে জানতে পারেন মাহরীনকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে প্রথমে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পরে তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়।

মাহরীন চৌধুরীকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের চালকই ফোন করে তাদের সেখানে যাওয়ার অনুরোধ করেন বলে জানান হেলাল। তিনি বলেন, যখন ওকে রেসকিউ করে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেছে, ওখান থেকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে করে বার্ন ইউনিটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমাকে অ্যাকচুয়েলি অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ফোন দিয়ে বলে, আপনি কি মাহরীন মিসের হাসব্যান্ড নাকি? ওনাকে বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনি বার্ন ইউনিটে আসেন।

হেলাল জানান, প্রথমে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের পাঁচ তলায় নিয়ে যাওয়া হয় নিহত মাহরীনকে। পরে সেখান থেকে আইসিইউতে নেয়া হয়। ভবনটির ভেতরে ঢুকে পড়ায় শরীরের প্রায় শতভাগই পুড়ে গিয়েছিল তার। ওই সময়ও তিনি জীবিত ছিলেন এবং মানসিকভাবে প্রচণ্ড শক্ত ছিলেন। সেই মুহূর্তে আমার যতটুকু ওর সাথে (কান্নায় ভেঙে পড়েন, কথা জড়িয়ে যায়)...তখনও সে অ্যালাইভ। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি দিয়ে সে সর্বোচ্চ কথাগুলো বলতেছিল। কারণ অলমোস্ট তার হান্ড্রেড পারসেন্ট বার্ন ইনার ও আউটার।

এই স্কুলেরই আরেক জন শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাস দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। বুধবার (২৩ জুলাই) তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে কোন ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থী ছিল তা লিখেছেন। কীভাবে মাহরীন চৌধুরীসহ অন্যান্য শিক্ষিকারা বাচ্চাদের বের করতে গিয়ে নিজেরাই আগুনে ঝলসে যান তাও উল্লেখ করেছেন। পূর্ণিমা দাস ওই স্কুলের ট্রেইনি শিক্ষিকা। প্রায় ১৫ দিন আগে ওই স্কুলে যোগদান করেন তিনি। ফেসবুকের এই পোস্টে তিনি নিহত ও আহতের সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য না ছড়াতে অনুরোধ করেন। 

আমি হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকব না

আমি হয়তো আর বেশিক্ষণ থাকবো না। তোমার সাথে হয়তো আমার জীবনের এটাই শেষ মুহূর্ত। আমি আর বেশিক্ষণ থাকব না। তুমি আমারে ক্ষমা কইরা দিও, আমি চলে যাচ্ছি––বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে নেয়ার আগে মাহরীন চৌধুরী শেষবারের মতো এই কথাগুলো বলছিলেন বলে জানান হেলাল। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি জানান, নিজের দুই সন্তানের কথা ভেবে কেন স্বার্থপর হননি- স্ত্রীকে এমন প্রশ্ন করেছিলেন।

যেহেতু গেটের সামনেই ছিলেন, তাই সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও কেন বের হয়ে যাননি এমন প্রশ্নে মাহরীন তাকে বলেন, ওই বাচ্চাগুলোও আমার বাচ্চা। ওই বাচ্চাগুলার মুখে আমার বাচ্চাগুলোর ছবি ভাসতেছিল। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে যতগুলা পারছি প্রায় ২০-২৫ জনকে টেনে বের করে দিছি। এরপরে কী হলো আমি জানি না (দ্বিতীয় বিস্ফোরণের সময়)।

হেলাল জানান, মাহরীন চৌধুরী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ার পর প্রথমবার আহত হন। কিন্তু ভবনটির নিচতলার শ্রেণিকক্ষে থাকা বাচ্চাদের উদ্ধার করতে ভেতরের দিকে এগিয়ে যান তিনি। ছোট ছোট শিশুদের অভয় দিয়ে "তোমাদের মিস তোমাদের সাথেই আছে, তোমরা শুধু দৌড়াও" মাহরীন এমন কথা বলেন। ভবন থেকে বের হওয়ার গেটেই বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ায় কিছু শিক্ষার্থী সেখানে আহত হয়।

বেশ কিছু শিক্ষার্থী বের হতে পারলেও বিধ্বস্ত বিমানে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ ঘটার পরে কী হয় তা আর টের পাননি বলে স্বামীকে জানিয়েছিলেন এই শিক্ষিকা। এ সময়ই তার সারা শরীর দগ্ধ হয়। হেলাল জানান, যখন আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে নিয়ে যাওয়া হবে সেই মুহূর্তে শেষবারের মতো তার হাত ধরার অনুরোধ করেন তার স্ত্রী। তিনি বলেন, যখন তাকে ভেন্টিলেশনে দেবে তার ঠিক আগ মুহূর্তে বলে–– তুমি আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। আমার হাতটা বুকের মধ্যে নিয়ে বলে–– তোমার সাথে এ জীবনে আমার আর দেখা হবে না। 

ফোনে এসব কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন হেলাল। নিহত মাহরীন চৌধুরীর দুই ছেলে। ১৫ বছর বয়সী বড় ছেলে এ বছর মাস্টার মাইন্ড স্কুল থেকে ও লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে। আর ১৩ বছর বয়সী ছোট ছেলেও একই স্কুলের ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী বলে জানান হেলাল। শেষবারের মতো মা মাহরীন চৌধুরী বড় ছেলেকে "মানুষের মতো মানুষ" হতে বলেন।

নিহত মাহরীন চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় যথাযথ মর্যাদা দেয়া হবে এমন আশা করেন তার স্বামী হেলাল। গত সোমবার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর দগ্ধ অবস্থায় মাহরীন চৌধুরীকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে ওই দিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। পরদিন নীলফামারী জেলার জলঢাকার বগুলাগাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খালাতো ভাই মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে নিহত মাহরীন চৌধুরী।

ভুল তথ্য ছড়াবেন না, ফেসবুক পোস্টে আরেক শিক্ষিকা

মাইলস্টোন স্কুলের ট্রেইনি শিক্ষক পূর্ণিমা দাস ফেসবুকে এক পোস্টে দোতলা ভবনটির নিচতলা ও দোতলার বিভিন্ন সেকশনে কত জন শিক্ষার্থী ছিল সে বিষয়ে উল্লেখ করেন। ওই পোস্টে ভুল তথ্য না ছড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। একই সাথে নিচ তলার ক্লাউড সেকশনে বাচ্চার সংখ্যা আট থেকে ১০ জন ছিল বলে উল্লেখ করেন এই শিক্ষক। আর এই সেকশন থেকেই মাহরীন চৌধুরীসহ তিন জন শিক্ষক বাচ্চাদের বের করার চেষ্টা করেছিলেন বলে লেখেন তিনি।

ফেসবুকে পূর্ণিমা দাস লিখেছেন, এরপর আসেন ক্লাউডে, ওখানে বাচ্চার সংখ্যা (৮-১০) স্কাই এর চেয়ে বেশি ছিল। আমার ধারনা মাহরীন মিস, মাসুকা মিস ও মাহ্ফুজা মিস ওখান থেকেই বাচ্চা বের করার চেষ্টা করছিলো। তাদের বের করতে করতে নিজেরা ঝলসে যায়। যার মধ্যে মাহরীন মিস এবং মাসুকা মিসকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মাহফুজা মিসের অবস্থা এখন গুরুতর, উনি লাইফ সাপোর্টে আছেন। উনার জন্য আপনারা দোয়া করবেন।

একই সাথে অন্যান্য সেকশন ময়না, দোয়েল, টিউবার রোজ, ওয়াটার লিলিতে থাকা শিক্ষার্থীদের অবস্থানও তুলে ধরেন তিনি। শিক্ষার্থীদের লাশ গুম হওয়ার যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেই এই স্ট্যাটাস দিয়েছেন পূর্ণিমা দাস। তিনি লেখেন, আপনাদের কোনো ধারণা নেই এই শিক্ষক-শিক্ষিকাগুলো কীভাবে বাচ্চাদেরকে সারাদিন আগলে রাখে। ছুটি হওয়ার সময় মাহরীন মিস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন বাচ্চাদেরকে অভিভাবকদের হাতে বুঝিয়ে দেয়। যতক্ষণ একটা বাচ্চারও অভিভাবক থাকে উনি গেট থেকে নড়েন না। তিনি ভুল তথ্য না ছড়ানোর জন্য সবাইকে অনুরোধ করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেয়া শিক্ষিকা মাহরীন শেষ মুহূর্তে যা বলেছিলেন

শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ দেয়া শিক্ষিকা মাহরীন শেষ মুহূর্তে যা বলেছিলেন

গভীর রাতে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা

গভীর রাতে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা

আগুনে কত শতাংশ পুড়লে প্রাণহানির শঙ্কা হয়?

আগুনে কত শতাংশ পুড়লে প্রাণহানির শঙ্কা হয়?

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: ২২ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: ২২ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App