শাসকের রাজনীতি বনাম শোষিতের লাশ
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৩:৩৫ এএম

সম্প্রতি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিনের আলোয় এক তরুণকে পাথর দিয়ে হত্যা করা হয়
ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিনের আলোয় এক তরুণকে পাথর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হলো। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেছে, কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ চিৎকার করেনি। এই নীরবতা শুধু আইন-শৃঙ্খলার নয়, এ এক জাতির আত্মার মৃত্যু। সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল—আলোচনায় সবার মুখে এক নাম: “টোকাই”।
কিন্তু আমার প্রশ্ন: কে মরেছে, কে মেরেছে—তা নয়। প্রশ্ন হলো: কেন বারবার মরছে এই শ্রেণিটাই? যে মরেছে, সে পথের মানুষ—দিন আনে দিন খায়। যার পেছনে নেই কোনো রাজনৈতিক পরিচয়, নেই কোনো আমলার ছায়া, নেই কোনো সাংবাদিকের কলম বা নেতার পৃষ্ঠপোষকতা। আর যারা মারছে? তারা হলো ক্ষমতার দালাল, রাজনীতির পেছনের অস্ত্রধারী বাহিনী। তাদের হাতে ছুরি থাকে, আর সেই ছুরির পেছনে থাকে রাষ্ট্রের নীরব অনুমোদন।
এদেশে যখন খুন হয় কেউ, যখন লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, তখন খেয়াল করুন—মৃতের নামের পাশে থাকে পরিচয় একটাই: “টোকাই”, “অজানা যুবক”, “কাজের ছেলে”, “ভবঘুরে”, “রিকশাওয়ালা”। কখনো কি শুনেছেন, কোনো মন্ত্রীর ছেলে রাস্তায় গুম হয়েছে? কোনো সচিবের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে? কোনো জেনারেলের ভাগ্নে কুপিয়ে খুন হয়েছে? না—একবারও না। কারণ এই রাষ্ট্র, এই সমাজ ও এই বিচারব্যবস্থা অলিখিতভাবে ঘোষণা করেছে—“মরার অধিকার কেবল শোষিত শ্রেণির।”
ঘটনার সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের তিন নম্বর গেটে আনসার ও নিরাপত্তাকর্মী ছিল। ফুটেজে দেখা যায়—তারা দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কিছুই করেনি। পুলিশ পরে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। রিমান্ড দিয়েছে। মামলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই বিচার কাদের জন্য? আজ পর্যন্ত কয়টা টোকাইয়ের হত্যার বিচার শেষ হয়েছে? রাষ্ট্র যখন প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সেটি অবহেলা নয়—এটি এক সামষ্টিক নিষ্ঠুরতা।
এই টোকাইরা কারা?
তারা জন্ম নেয় বস্তিতে, ফুটপাথে, কোনো ঘূর্ণিঝড়ের রাতে বা কোনো অস্থির রাজনৈতিক সময়ে। তাদের ঠাঁই নেই স্কুলে, হাসপাতালের ওয়ার্ডেও “ভিআইপি রোগী”দের চাপে তারা জায়গা পায় না।
তবু তারা ব্যবহার হয়—
• মিছিলে ভাড়া খাটা শ্রমিক হিসেবে
• গ্যাং লিডারের ছায়া বাহিনী হিসেবে
• লাঠি হাতে স্লোগান দেওয়া পেটুয়া হিসেবে
• ভোট কারচুপির ‘ইতর’ হাতিয়ার হিসেবে
• পিকেটিং, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক অস্থিরতার ‘ইন্ধন’ হিসেবে
তারা গুলি খায়, জেলে যায়, মরেও যায়। আর রাষ্ট্র কেবল দেখে—তামাশা। তবে সত্যিটা আরও নিষ্ঠুর। এই দেশে ধর্ষণ হয় প্রতিদিন।
কিন্তু ধর্ষণের শিকার হয়—
• গার্মেন্টস কর্মীর মেয়ে,
• কোনো পাহাড়ি কিশোরী,
• বাসার কাজের মেয়ে,
• পথে থাকা কিশোরী।
কিন্তু ধর্ষণ হয় না—
• পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা,
• সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীর বোন,
• মন্ত্রীর মেয়ে,
• কোনো সচিবের আত্মীয়া।
এটা কি কাকতালীয়?
না। এটা হলো এক নিষ্ঠুর সামাজিক চুক্তি—ক্ষমতাবান নিরাপদ, শোষিত অসহায়। তাদের শরীর স্পর্শের আগেই রাষ্ট্র প্রহরায় দাঁড়িয়ে যায়। আর আমরা? আমরা দেখি, ক্যামেরা চালাই, পোস্ট দেই। আলোচনায় বলি—“কী ভয়াবহ!” কিন্তু প্রতিরোধ করি না। রাস্তায় দাঁড়াই না। জবাব চাই না। তাহলে আসল অপরাধী কারা? ছুরি চালানো ছেলেটি? না।
সবচেয়ে বড় অপরাধী—
• যারা দেখেছে, কিন্তু মুখ বন্ধ রেখেছে,
• যারা ক্যামেরা ধরেছে, কিন্তু বাঁধা দেয়নি,
• যারা জানে কারা এসব ঘটায়, তবুও চুপ থেকেছে,
• যারা দরিদ্রের রক্ত দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা পোক্ত করে।
তারা রাষ্ট্রের সম্মানিত দানব। আর আমি? আমি নিজেও সেই অপরাধীদের একজন। আমি জানি কারা মারছে। জানি কারা ব্যবহার করছে। জানি কারা এই রাজনীতি পরিচালনা করে। তবুও প্রতিবাদ করিনি। মিছিল করিনি। জবাব চাইনি। শুধু লিখেছি, পড়েছি, চা খেতে খেতে আলোচনা করেছি। এভাবে জাতি বাঁচে না। আমরা গড়ে তুলেছি এক ভয়াবহ মানবিক দেউলিয়াপনার সমাজ যেখানে প্রতিবাদ বিলাসিতা, সহানুভূতি বিলুপ্ত, ন্যায়বোধ নিঃশেষ।
আমরা মানুষ নই, হেঁটে বেড়ানো যান্ত্রিক ক্যামেরা মাত্র— যারা মৃত্যু দেখে ভিডিও করে, যারা আর্তনাদ শুনে মিম বানায়, যারা বিচার চাইলে বলে—“গেটআউট”। এই সমাজ শুধু ভয়ঙ্কর নয়, আত্মঘাতীও। এই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র নয়, এ এক প্রাতিষ্ঠানিক খুনের কারখানা। আজ টোকাই মরেছে। আগামীকাল মরবে গার্মেন্টস কর্মী, তারপর কোনো প্রতিবাদী শিক্ষক, তারপর এক সাংবাদিক, তারপর আপনি।
হ্যাঁ—আপনি। কারণ রাষ্ট্র যখন কেবল গরিবদের মারতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তার পরবর্তী শিকার হতে পারে যে কেউ। তাই বলছি— এই লেখা কোনো আবেগ নয়। এটি কোনো পলিশড ভাষণ নয়। এটি একটি জাতির বিবেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগপত্র।
আপনি আজ যদি মুখ না খোলেন, আপনি আজ যদি প্রতিবাদ না করেন, আপনি যদি আজও চুপ থাকেন— তাহলে আগামী লাশটা কাঁধে তোলার সময়, হয়তো আপনি নিজেই হবেন সেই লাশের পরিচিত মুখ।
রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন, [email protected]