নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতি, অবিচার ও অন্যায়কে বিদায় দিতে হবে
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:০৫ এএম

নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতি, অবিচার ও অন্যায়কে বিদায় দিতে হবে
তুমি চলে গেলে আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চোরে রাতে স্ত্রীর সমস্ত গয়না নিয়ে গেল, আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। দেশটি চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছে, আমিও চেয়ে চেয়ে দেখছি। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। আমরা বারবার অন্যায়, দুর্নীতি আর অবিচার চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, অথচ চুপ করে থাকছি। এই নীরবতা ভাঙতেই হবে। বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে গেছে এমন এক সন্ধিক্ষণে, যেখানে দর্শক হয়ে থাকার সময় শেষ— বাংলাদেশ প্রস্তুত পরিবর্তনের জন্য, প্রস্তুত নিজের অধিকার ফিরে নেওয়ার জন্য।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের ভুলে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। মানুষ বারবার আশা করে সেই নেতৃত্বের কাছ থেকে, যাদের অতীত ভরা ছিল দুর্নীতি আর ব্যর্থতার দাগে। শাসনামলে দেশ একাধিকবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছিল—এটা শুধু কোনো সংখ্যা নয়, বরং প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজে গভীর ক্ষতের প্রমাণ।
তবুও আজও মানুষ তাকিয়ে থাকে সেই পুরনো নেতাদের দিকেই, যারা অতীতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাদের চিন্তাধারা বা কাজে বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। তাহলে তাদের কাছ থেকে সততা আর সুশাসনের আশা করা কতটা বাস্তবসম্মত?
আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো—মানুষ যখন এক নেতৃত্বে বিরক্ত হয়, তখন অন্য কারো দিকে তাকায়; অথচ সেই নেতৃত্বও অতীতে দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত। ফলে ক্ষমতার পালাবদল হলেও সাধারণ মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না। একের পর এক শাসনব্যবস্থার আসা-যাওয়া আসলে এক ধরনের দুষ্টচক্র, যেখানে দুর্নীতি, আত্মীয়প্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চায়, তবে পুরনো নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। দরকার নতুন চিন্তার নেতৃত্ব—যারা সৎ, নীতিবান, জবাবদিহিতার মধ্যে থাকবে এবং নতুন প্রজন্মের আশা পূরণ করতে পারবে। পুরনো ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি না করে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন নেতৃত্ব আর নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে।
না হলে দুর্নীতির অন্ধকার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা যাবে না, আর মানুষও বারবার প্রতারিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে যেন এক অন্তহীন সংকটে আবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের শপথ ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই অঙ্গীকারকে পুঁজি করেই ক্ষমতাসীনরা বারবার জনগণকে প্রতারিত করেছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও নাগরিকরা এখনো সত্য থেকে বঞ্চিত, গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন, শোষণ ও দুঃশাসনের অন্ধকারে বন্দী।
ক্ষমতাকে জনগণের সেবার উপকরণে পরিণত করার পরিবর্তে, শাসকেরা এটিকে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তরিত করেছে—একটি স্বার্থান্বেষী শ্রেণি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে জনগণকে দমিয়ে রাখার জন্য। এই দুঃখজনক বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন প্রার্থনা: “আরও আলো, আরও প্রাণ, আরও মুক্তি।” আজ এই আহ্বান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও প্রাসঙ্গিক।
জনগণের “আরও আলো” প্রয়োজন—কারণ তারা সত্য, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাহীন শাসন থেকে মুক্তি চায়। তাদের “আরও প্রাণ” প্রয়োজন—কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আড়ালে জীবনের প্রাণশক্তি ও সৃজনশীলতা নিঃশেষ হচ্ছে বৈষম্য, দুর্নীতি ও বেকারত্বে। আর সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের দরকার “আরও মুক্তি”—স্বৈরশাসনের ভয় থেকে মুক্তি, অন্যায়ের শিকল থেকে মুক্তি, এবং এক দমনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে মুক্তি।
বাংলাদেশের এই দুঃসহ চক্র ভাঙতে হলে নতুন রাজনীতির দরকার—যে রাজনীতি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার নয়, বরং জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। যে নেতৃত্ব আত্মস্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে। যে রাষ্ট্র মানুষকে বন্দী করবে না, বরং মুক্তি দেবে—চিন্তার মুক্তি, বাকস্বাধীনতার মুক্তি, ন্যায়বিচারের মুক্তি। এখনই সময় রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন আহ্বানকে জাতীয় মন্ত্রে পরিণত করার: “আরও আলো, আরও প্রাণ, আরও মুক্তি।”
আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলি—এই সমাজকে আমরা আর মেনে নেব না, যেখানে লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা আমাদের গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের “ভিখারির সন্তান” বলে অপমান করে! মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলত দরিদ্র ছেলে-মেয়েরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। আর আজ তাদের ত্যাগকে যারা অস্বীকার করে, ইতিহাস বিকৃত করে, তারা আসলেই এই দেশের শত্রু।
বাংলাদেশের ইঞ্জিন হলো দরিদ্র পরিবার থেকে আসা সেই গ্রামীণ ছেলে-মেয়েরা। তারা গার্মেন্টসে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, তারা বিদেশে ঘাম ঝরিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে, তারা মাঠে খাদ্য ফলাচ্ছে আমাদের পেটের ভাতের জন্য, তারা ট্রাক-বাস-ভ্যান চালিয়ে পুরো দেশকে সচল রাখছে। এরা এই জাতির মেরুদণ্ড। অথচ রাজনীতির মাঠে এদের অপমান করা হয়, তুচ্ছ করা হয়। আমরা আর এটি সহ্য করব না।
সমাজে ছদ্মবেশী সাপেরা আছে—বাইরে ভদ্রবেশে, ভেতরে বিষে ভরা। তারা লোভ, অর্থ ও ক্ষমতার নেশায় মত্ত, অবৈধ টাকা বানিয়ে বিলাসী জীবন কাটায়, আর গ্রামীণ ছেলেমেয়েদের স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নৈতিক বিদ্রোহ গড়ে তুলতে হবে। আমরা ভাঙব সেই সমাজ, যেখানে সৎ শিক্ষার্থীকে তুচ্ছ করা হয়। আমরা গড়ব নতুন বাংলাদেশ—যেখানে ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, প্রবাসী আর চালকের ঘামে ভিজে রচিত হবে সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।
আমরা সেই বাংলাদেশ চাই না, যেখানে ইতিহাস বিক্রি হয়, যেখানে ত্যাগ অস্বীকৃত হয়, যেখানে দুর্নীতিবাজ সাপেরা ক্ষমতার সিংহাসনে বসে থাকে। আমরা চাই এমন বাংলাদেশ, যেখানে মেধা, সততা, ত্যাগ ও ন্যায়বিচার হবে জাতির সর্বোচ্চ মূল্যবোধ।
তাহলে আসুন, সবাই মিলে শপথ নিই— আমরা অন্যায় মানব না, দুর্নীতি মানব না, অপমান মানব না! আমরা একসাথে গড়ব নতুন বাংলাদেশ! নেতৃত্ব মানে কেবল পরীক্ষায় সেরা হওয়া নয়; নেতৃত্ব মানে সবার পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়কে অস্বীকার করা এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃত নেতা সে, যে সাহসের সাথে দুর্নীতি ও বৈষম্যের প্রতিবাদ করে। শিক্ষাজীবনে যারা শুধু বইয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে, তারা হয়তো ভালো পেশাজীবী হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত নেতা হতে হলে চরিত্রের দৃঢ়তা, নৈতিকতার শক্তি এবং মানুষের জন্য আত্মত্যাগের মানসিকতা থাকা অপরিহার্য।
আমরা যদি ভবিষ্যৎ সমাজের জন্য আলোকিত নেতা গড়তে চাই, তবে একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া, প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। সুইডেনে যে কোনো রাজনৈতিক দল মোট ভোটের ৪% এর বেশি পেলে সংসদে আসন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার দেশে বর্তমানে ৮টি দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশের ভোট-ব্যবস্থা নিয়ে যারা বলেন জনগণ PR পদ্ধতির সাথে পরিচিত নয়, তাদের উদ্দেশ্যে আমি জানাই— ১) জনগণ কখনোই প্রকৃত অর্থে ন্যায্য ভোট-ব্যবস্থা পাননি। ২) এমপিদের কাজ স্থানীয় সমস্যা সমাধান নয়, আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ। ৩) স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে আয়োজন করা যেতে পারে।
অতএব, কোনো একক দল যেন সবকিছু দখল করতে না পারে। সংসদে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এটাই একমাত্র ন্যায্য ও নৈতিক পথ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ডাক এখনই—আর কোনো দেরি নয়। এ বার্তাই হবে জাতির শপথ: আরও আলো, আরও প্রাণ, আরও মুক্তি, আরও জ্ঞান।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, (সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন), [email protected]