×

মতামত

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৪ এএম

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। এই ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলিম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। একে অপরের উৎসবে অংশ নেয়া, বিপদের সময় সহযোগিতা করা এবং সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। যদিও মাঝেমধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শান্তির আবহে আঘাত হানে তবুও বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও মিলেমিশে থাকার অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারই আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রথম স্তম্ভ আমাদের সংবিধান। যেখানে ২(ক) অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও একই অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে—সব ধর্মের অনুসারীরা সমান মর্যাদা ও সমঅধিকার ভোগ করবেন। পাশাপাশি ১২ নং অনুচ্ছেদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’কে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোর একটি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর ৪১ নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামো একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় পরিচয়কে স্বীকার করে, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সমানভাবে সুরক্ষিত রাখতে বাধ্য করে।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে পার্বণ–অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক অংশগ্রহণের সুন্দর চর্চা রয়েছে। দুর্গাপূজার মণ্ডপে মুসলিম তরুণদের স্বেচ্ছাসেবক দল, ঈদে প্রতিবেশী অমুসলিমদের সঙ্গে খুশি ভাগাভাগি, বৌদ্ধ পূর্ণিমায় সমবায় উদ্যোগ—এসব দৃশ্য আমরা সব সময় দেখতে পাই। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক পর্যায়েও উৎসবকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন অনেক বেশি। পূজা–মণ্ডপে সিসিটিভি, পুলিশ–র‌্যাব–আনসার–বিজিবি’র টহল, স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, মণ্ডপভিত্তিক মনিটরিং কমিটি—এসব নির্দেশনা গত কয়েক বছর ধরে প্রশাসনের লিখিত গাইডলাইনের অংশ।

তবে এই সম্প্রীতির মধ্যে কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংসতা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সম্প্রতি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর ভেঙে তার মরদেহ উত্তেজিত জনতা তুলে পুড়িয়ে দেয়। এ হামলায় অন্তত ৫০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে দরবারের ভক্তরা ছিলেন বেশি। এ সময় ইউএনওর গাড়ি এবং পুলিশের দুটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। পরে সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। যদিও এরই মধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এ বিষয়ে অনেক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

সমাজে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। যা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)।’এছাড়া অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন,‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়’- (বুখারি)। অন্য এক  হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সামর্থ্য বহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সেই ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো (আবু দাউদ)।’

বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির একটি মিলনস্থল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭১ সালে ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করে সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতে লড়াই করা হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বহু ত্যাগের বিনিময়ে গঠিত নতুন জাতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সংবিধান সব নাগরিকের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে কৌশল তৈরি করার সময় আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করে। তথাপি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে একটি স্থায়ী সমস্যা, যা প্রায়ই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট দাঙ্গা (২০০২) চলাকালীন ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমরা কিছু কৌশল ব্যবহার করে টেকসই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে পারি।

প্রথমত, আইনের শাসন ও দ্রুত বিচার। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ‘দায়মুক্তি’র সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারি।

দ্বিতীয়ত, প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা ও স্থানীয় অংশীদারত্ব। ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা বা যে কোনো বৃহৎ সমাবেশ–উৎসবের আগে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আয়োজকদের মধ্যে সমন্বয় সভা, সিসিটিভি–স্বেচ্ছাসেবক–টহল—এসবকে বাধ্যতামূলক মানদণ্ডে রূপ দিতে হবে এবং পরে মূল্যায়ন রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল গুজব দমন ও তথ্য–সচেতনতা। অধিকাংশ সহিংসতার প্রাক্কালে ভুয়া খবর বা বিকৃত ছবি–ভিডিও ছড়ানোর নজির রয়েছে। তাই দ্রুত ফ্যাক্ট–চেকিং ব্যবস্থা, প্ল্যাটফর্ম–স্তরের কনটেন্ট মডারেশন সমন্বয় এবং স্থানীয় ভাষায় জনসচেতনতা ক্যাম্পেইন চালাতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিক শিক্ষা—বিশেষত স্কুল–কলেজে ‘ডিজিটাল লিটারেসি’বিষয়ে পড়াতে হবে।

চতুর্থত, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন। কোনো ঘটনার পর দ্রুত ক্ষতিপূরণ, মন্দির–গির্জা–বিহার–ঘরবাড়ি পুনর্গঠন এবং ভয়ের পরিবেশ কাটাতে প্রশাসনিক তৎপরতা অত্যন্ত জরুরি। এতে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা বাড়ে এবং প্রতিশোধ–চক্র ঠেকানো যায়।

পঞ্চমত, নাগরিক–সমাজের উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। দেশে বহু আন্তধর্মীয় সংলাপ–ফোরাম, শান্তি কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক আছে—এদের প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র অনুদান ও তথ্য–সহায়তা দিয়ে টেকসই করা দরকার। উৎসব–কেন্দ্রিক ‘ইন্টারফেইথ ভলান্টিয়ার কোর’ গড়া যেতে পারে, যেখানে তরুণরা মিশ্র দল হিসেবে মণ্ডপ–মসজিদ–গির্জা–বিহারে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় যুক্ত থাকবে।

বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের মূল শক্তি হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ভৌগোলিক সীমানা, ইতিহাস কিংবা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, আমাদের সংস্কৃতি সবসময় মিলেমিশে থাকার শিক্ষা দিয়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু অশান্তি বা গুজব এই সম্প্রীতিকে নষ্ট করার চেষ্টা করে কিন্তু সেসব ক্ষণস্থায়ী। তাই আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আইন ও নীতির সঠিক প্রয়োগ, গুজব–বিদ্বেষের কঠোর মোকাবিলা এবং সংখ্যালঘু–সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে ৮ কোটি টাকার মামলা

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে ৮ কোটি টাকার মামলা

প্রশাসক নিয়োগ বৈধতার শুনানির আগে নগদ বিক্রির প্রক্রিয়া অবৈধ: সুপ্রিম কোর্ট

প্রশাসক নিয়োগ বৈধতার শুনানির আগে নগদ বিক্রির প্রক্রিয়া অবৈধ: সুপ্রিম কোর্ট

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

মোজাহেদুল ইসলামের ‘এআই শিখুন, টাকা গুনুন’ বইয়ের প্রি-অর্ডার শুরু

মোজাহেদুল ইসলামের ‘এআই শিখুন, টাকা গুনুন’ বইয়ের প্রি-অর্ডার শুরু

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App