ব্যাংকিংয়ের ডিজিটাল রূপান্তরে নারীর নেতৃত্ব: সাবিহা শারমিনের অভিজ্ঞতা
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:০৬ পিএম
ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসির ডিজিটাল ব্যাংকিং ডিভিশনে এক্সিকিউটিভ অফিসার সাবিহা শারমিন
তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি খাত এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তবে এই খাতের কিছু শাখাকে, বিশেষ করে হার্ডকোর নেটওয়ার্কিং, সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা ব্যাংকিং-এর মতো জটিল ফিনটেক সিস্টেম পরিচালনার কাজকে এখনও অনেকেই 'পুরুষদের কাজ' বলে মনে করেন। এই প্রথাগত ধারণার দেওয়াল ভেঙে যে নারীরা প্রযুক্তির জগতে নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন, তাদেরই একজন সাবিহা শারমিন।
একজন ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে, পরে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন অর্জন করেছেন তিনি। নোকিয়া সলিউশনসের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় আট বছর টেকনিক্যাল সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার পর তিনি যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেবায়।
বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসির ডিজিটাল ব্যাংকিং ডিভিশনে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার বিভিন্ন আধুনিক ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশন বাস্তবায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আজ আমরা সাবিহা শারমিনের মুখ থেকেই শুনবো তার এই দীর্ঘ টেক-জার্নির গল্প, ফিনটেক খাতের চ্যালেঞ্জ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী অন্য নারীদের জন্য তার অনুপ্রেরণার কথা।
ভোরের কাগজ: আপনি ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং বিভাগে কাজ করছেন। আপনার প্রতিদিনের কাজ এবং প্রধান দায়িত্বগুলো যদি আমাদের পাঠকদের জন্য সহজ করে বলতেন।
সাবিহা শারমিন: ধন্যবাদ আপনাকে। সহজ কথায়, আমার কাজ হলো গ্রাহকরা যেন ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবাগুলো সহজে এবং নিরাপদে ব্যবহার করতে পারেন তা নিশ্চিত করা। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল এপ্লিকেশন (NBLipower ন্যাশনাল ব্যাংকের অ্যাপ) এবং নতুন গ্রাহক নিবন্ধনের অ্যাপগুলো ঠিকমতো চলছে কিনা তা দেখভাল করা। এই সিস্টেমগুলোর সার্ভার ম্যানেজমেন্ট, নিরাপত্তা আপডেট দেওয়া এবং এগুলো যেন ব্যাংকের মূল কোর ব্যাংকিং সলিউশনের (সিবিএস) সাথে সঠিকভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে, তা নিশ্চিত করা আমার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
ভোরের কাগজ: আপনার শিক্ষাগত পটভূমি পরিবর্তনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জিং—ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি এবং পরে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স। একজন নারী হিসেবে এই 'হার্ডকোর' টেকনিক্যাল লাইনে আসার পেছনের অনুপ্রেরণা কী ছিল?
সাবিহা শারমিন: (হেসে) টেকনোলজির সাথে নিজেকে গড়ে তোলাই ছিল অনুপ্রেরণা। আমি যখন বিএএফ শাহীন কলেজ, যশোরে পড়ি, তখন থেকেই সায়েন্সের প্রতি ঝোঁক ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্তটা সেখান থেকেই। অনেকেই হয়তো ভাবতো এই বিষয়গুলো মেয়েদের জন্য নয়, কিন্তু আমার পরিবার সবসময় আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে, প্রযুক্তি এমন একটা জায়গা যেখানে মেধা এবং দক্ষতার মূল্যই আসল, জেন্ডার নয়। টেলিকমিউনিকেশন আমাকে নেটওয়ার্কিং শিখিয়েছে, আর কম্পিউটার সায়েন্স আমাকে সিস্টেমের গভীরে যেতে সাহায্য করেছে।
ভোরের কাগজ: আপনার প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন আছে। সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নেটওয়ার্কিং-এর কাজগুলোকে অনেকেই নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং মনে করেন। এই প্রথাগত ধারণাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাবিহা শারমিন: এই ধারণাটা এখন অনেকটাই বদলে গেছে। দেখুন, আমার ক্যারিয়ারের শুরুটাই ছিল নেটওয়ার্ক সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এটা সত্যি যে, সার্ভার বা নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্টে মাঝে মাঝে অফ-আওয়ারে বা ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। কিন্তু এটা পদের দায়িত্বের অংশ, নারী বা পুরুষের বিষয় নয়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমি যখন নোকিয়া সলিউশনসে টেকনিক্যাল সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতাম, তখন সার্ভার বা সিস্টেম ম্যানেজ করেছি। চ্যালেঞ্জ এসেছে, কিন্তু সেগুলো সফলভাবে সমাধান করার পর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। দক্ষতা থাকলে যেকোনো চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করা সম্ভব।
ভোরের কাগজ: আপনি নোকিয়ার মতো একটি গ্লোবাল টেলিকম কোম্পানিতে প্রায় ৭ বছর কাজ করার পর হঠাৎ ব্যাংকিং বা 'ফিনটেক' খাতে চলে আসলেন। এই বড় পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটা কেন নিলেন?
সাবিহা শারমিন: এই সিদ্ধান্তের কারণটা একটু টেকনিক্যাল। টেলিকমিউনিকেশন এর ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুই আইটি নির্ভর হচ্ছে। নোকিয়াতে আমার অভিজ্ঞতা ছিল সিস্টেম, সার্ভার আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে। আমি দেখছিলাম, ফিনটেক বা ডিজিটাল ব্যাংকিং খাতটি বাংলাদেশে দ্রুত বড় হচ্ছে। এখানে আমার টেলিকম ও আইটি অভিজ্ঞতাকে সরাসরি গ্রাহকসেবায় রূপান্তর করার একটা বড় সুযোগ ছিল। ব্যাংকিং এর বিভিন্ন নতুন প্রজেক্ট হচ্ছে। এই প্রজেক্টগুলোতে সরাসরি অবদান রাখার লোভটা সামলাতে পারিনি।
ভোরের কাগজ: আপনার প্রফেশনাল সার্টিফিকেটগুলো আপনি ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর প্রজেক্টগুলোতে কীভাবে কাজে লাগান?
সাবিহা শারমিন: এটা খুবই চমৎকার একটা প্রশ্ন। দেখুন, শুধু টেকনিক্যাল জ্ঞান দিয়ে একটা প্রজেক্ট সফল করা কঠিন, আবার শুধু ম্যানেজমেন্ট জানলে টেকনিক্যাল টিমের চ্যালেঞ্জ বোঝা কঠিন। আমার প্রফেশনাল সার্টিফিকেট এর জ্ঞান আমাকে প্রজেক্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা করতে, রিস্ক ম্যানেজ করতে এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের (যেমন ভেন্ডর, ইন্টারনাল টিম) সাথে সমন্বয় করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, আমার টেকনিক্যাল জ্ঞান (যেমন কোর ব্যাংকিং সিস্টেম বা নেটওয়ার্কিং) আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে ঠিক কোথায় সমস্যা হতে পারে বা একটা নতুন ফিচার চালু করতে টেকনিক্যালি কী কী করা প্রয়োজন। এই দুইয়ের সমন্বয় থাকায় আমি টিমের সাথে এবং ভেন্ডরের সাথে অনেক সহজে কাজ করতে পারি।
ভোরের কাগজ: আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে, তথ্যপ্রযুক্তি বা ফিনটেক খাতে নারীদের অংশগ্রহণের হার কেমন দেখছেন? পরিবেশ কতটা নারী-বান্ধব?
সাবিহা শারমিন: আমি যখন ক্যারিয়ার শুরু করি (প্রায় ২০১৫-২০১৬ সালে), তখন টেকনিক্যাল টিমগুলোতে নারী সহকর্মীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই চিত্রটা খুব দ্রুত বদলেছে। বিশেষ করে ন্যাশনাল ব্যাংকে আমার ডিজিটাল ব্যাংকিং টিমে আমরা বেশ কয়েকজন নারী একসাথে কাজ করছি। আমি বলবো, পরিবেশ এখন অনেক বেশি সাপোর্টিভ। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বুঝতে পারছে যে, একটি বৈচিত্র্যময় টিম ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারে। হ্যাঁ, এখনও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, তবে আমি খুবই আশাবাদী।
ভোরের কাগজ: সবশেষে, যে মেয়েরা বা ছাত্রীরা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং বা কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছে, কিন্তু আইটি বা ফিনটেক-এ ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে কিছুটা দ্বিধা বা ভয়ে আছে, তাদের জন্য আপনার প্রধান পরামর্শ কী থাকবে?
সাবিহা শারমিন: আমার প্রধান পরামর্শ তিনটি: ১. ভয় পাবেন না: কোনো কাজই নারী বা পুরুষের জন্য আলাদা করে তৈরি হয়নি। আপনার যদি আগ্রহ থাকে, তবে সাহসের সাথে এগিয়ে আসুন। ২. দক্ষতা অর্জন করুন: শুধু একাডেমিক পড়াশোনা নয়, প্রফেশনাল সার্টিফিকেশন অর্জনের চেষ্টা করুন। এগুলো আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে। ৩. শেখা বন্ধ করবেন না: টেকনোলজি প্রতিদিন বদলাচ্ছে। আমি টেলিকম থেকে ফিনটেকে এসেছি। আপনাকেও নতুন কিছু শেখার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি আপনার প্যাশন থাকে এবং আপনি পরিশ্রম করতে রাজি থাকেন, তবে এই সেক্টরে আপনার সাফল্য কেউ আটকাতে পারবে না।

