ডাকসু নির্বাচন: ভোটারদের ‘লাল কার্ড’

মাহমুদ সোহেল, বিশেষ প্রতিনিধি, জিটিভি
প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক চিন্তাশীল শিক্ষার্থীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ভোট দিয়েছে? নাকি এখানে ভিন্ন কিছু আছে। হিসাব মিলাতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। এর মাধ্যমে ভোটাররা কাকে লাল কার্ড দেখালো? সেই আলোচনার আগে আরো কিছু কথা থাকে। আমার মনে হয় গত ৫৪ বছরের রাজনীতির বন্দোবস্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে ভোটাররা। বস্তা পচা আর দেশকে পেছনের দিকে টেনে ধরার রাজনীতিকে ব্যালটে না বলে দিয়েছে তারা।
প্রশ্ন হলো ছাত্রশিবিরকে কেন তারা বেছে নিলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বহু আগে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের পর থেকেই গৎবাঁধা দোষারোপের রাজনীতিতে আটকে আছি আমরা। ভারতের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব আর তাদের পোষ্য রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নির্দিষ্ট কিছু ন্যারেটিভ তরুণ সমাজ মানতে নারাজ। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইস্যু বানিয়ে দেশের ভিতর ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’ নীতি জোরালোভাবে চালু রেখেছে ভারত।
এই একটি থিওরিকে কাজে লাগিয়ে ১৬টি বছর ভারতের কাছে বাংলাদেশকে ইজারা দিয়ে রেখেছিল স্বৈরশাসক হাসিনা। বলা যায়, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে খেলছে ভারত। তরুণ সমাজ এখন তা খুব ভালো করে বোঝে। তাই যারাই ভারতের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবে তাদেরকেই আগামীতে প্রতিহত করবে তরুণ ছাত্র সমাজ। ডাকসু নির্বাচন আমাদেরকে সেই বার্তা দেয়।
এখনো বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা ভারতের গুটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পরও রাজনৈতিক দলগুলোর হুঁশ ফেরেনি। এখনো তারা বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটছে। এই বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তাই ডাকসু নির্বাচনে নতুন কিছু চেয়েছে তারা। বলে রাখা দরকার, ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই সব সময় জারি রেখেছিল দেশের ছাত্র সমাজ। তারই উদাহরণ শহীদ আবরার ফাহাদ।
৩৬ জুলাই সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ সামনে এসেছে। এখান থেকে আর পিছনে ফিরতে চায় না ছাত্র সমাজ। তাই এবারের ডাকসু নির্বাচন দেশের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি বড় সতর্ক বার্তা। প্রশ্ন হচ্ছে কেন ছাত্রদলের মতো বড় ছাত্র সংগঠনকে ছুড়ে ফেলে দিলো তারা? এই আলোচনা অনেক দীর্ঘ। তবে সংক্ষেপে বলা যায়, গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র সমাজের টেস্ট অফ ভেরিয়েশন বুঝতে পারেনি ছাত্রদল। নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেনি ছাত্র সমাজের সামনে। তারা ভারতের শিখিয়ে দেয়া সেই বুর্জোয়া স্লোগান নিয়েই শিবিরকে ঘায়েল করতে চেয়েছে। ছাত্র সমাজ এটা পছন্দ করেনি। বরং ছাত্রদল-শিবিরসহ দেশের সব ছাত্র সংগঠন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে এই প্রত্যাশাই ছিল শিক্ষার্থীদের। হতাশ হয়েছে তারা। মন্দের ভালো হিসেবে ছাত্র শিবিরকে বেছে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটাররা।
তাছাড়া গত এক বছর ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলেছে। কাজ করার চেষ্টা করেছে। গতানুগতিক গেস্ট রুম কালচার, ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়া, গণরুম আর জোর করে মিছিলে নেয়ার সেই রাজনীতির বাইরে কিছু কর্মসূচি শিবির দেখানোর চেষ্টা করেছে। যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে নতুনত্ব মনে হয়েছে। তবে ভোটের এই পরিসংখ্যানে শিবিরের খুব বেশি খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা এক বছর শিবিরকে অব্জার্ভ করবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তারা কী কী কাজ করবে ওপর নির্ভর করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ভবিষ্যৎ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হলের ২১৬ নাম্বার রুমের বৈধ ছাত্র ছিলাম। ২০০৯ সাল থেকেই শিবির মারলে ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার উৎসব দেখেছি। দেখেছি হল ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, মিছিলে না গেলে নেতাদের রুমে ডেকে নিয়ে নির্মম নির্যাতন। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার্থীরা এমন নানা নির্যাতনে নিষ্পেষিত। এ থেকে মুক্তি চায় তারা। তাদের এই মুক্তির কথা শিবির বলতে পেরেছে তাদের ইশতেহারে। ছাত্রদলও বলেছে তবে আস্থা অর্জন করতে পারেনি ভোটারদের।
দেশের সবচেয়ে রাজনৈতিক সচেতন এলিট ভোটার ডাকসুতে। বিশ্ব রাজনীতি, ভূ-রাজনীতি সবই তাদের জানা। তাই চাপিয়ে দেয়া কোনও রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তাদেরকে কাবু করতে পারে না। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার বা গণমাধ্যম কী বলল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে তারা। তবে এত বড় বিজয়ে শিবিরের আত্মতুষ্টির কারণ নাই। এই শিক্ষার্থীরাই আগামী ডাকসু নির্বাচনে শিবিরকে বয়কটের ক্ষমতা রাখে। তারা মন্দের ভালোকে বেছে নিয়েছে। তাছাড়া শিবির এক বছরের কর্ম পরিকল্পনায় তাদের ইশতেহারে কিছু কর্মসূচি তুলে ধরতে পেরেছে যা ছাত্রদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে।
তারা ছাত্রদলের মাধ্যমে বিএনপিকে বার্তা দিতে চেয়েছে। পরিবর্তনের বার্তা। তারা ভোট দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে। দলাদলি-হানাহানি আর ট্যাগিংয়ের রাজনীতি পছন্দ না তাদের। এগিয়ে যাওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী তারা। তাই তো এই নির্বাচনে ভারতের দখলদারিত্ব মনোভাবকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছে ভোটাররা। ভোট দিয়েছে পরীক্ষিত ভারত বিরোধী শক্তিকে।
লেখক: মাহমুদ সোহেল, বিশেষ প্রতিনিধি, জিটিভি