×

মুক্তচিন্তা

নতুন প্রজন্মের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় এই যুগের বাস্তবতা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১২ পিএম

নতুন প্রজন্মের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় এই যুগের বাস্তবতা

নতুন প্রজন্মের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় এই যুগের বাস্তবতা

আধুনিক মানুষের হারানো ছন্দ ও ভবিষ্যতের দায় – আমাদের যুবসমাজের অস্থিরতা, সমাজের ভূমিকা এবং নৈতিক পুনর্জাগরণের আহ্বান বিশ্বের এক অদ্ভুত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে—অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করা। যেখানেই যাওয়া যায়, একই কথা শোনা যায়: “আগে আমরা ভালো ছিলাম।”

যেন সময়ের প্রতিটি পরিবর্তন মানেই অবক্ষয়, প্রতিটি নতুন প্রজন্ম মানেই নৈতিক বিপর্যয়। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মানে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার নয়—এটা মানে মানবতার নতুন অনুশীলন? আমরা এখন এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে মানুষ সময়ের সঙ্গে এগোচ্ছে, কিন্তু আত্মার সঙ্গে নয়। চিন্তা দ্রুত হচ্ছে, যোগাযোগ সহজ হচ্ছে, কিন্তু অনুভূতির গভীরতা হারিয়ে যাচ্ছে।

এক প্রজন্মের বিভ্রান্তি আজকের তরুণ প্রজন্ম—তারা বুদ্ধিমান, তারা দক্ষ, কিন্তু তারা দিশাহীন। তাদের জীবনে আছে অসংখ্য বিকল্প, কিন্তু নেই একটিমাত্র লক্ষ্য। তারা সংযুক্ত (connected), কিন্তু একা (isolated)। তাদের হাতে পৃথিবীর জ্ঞান, কিন্তু মস্তিষ্কে নেই  অভিমুখ।

এরা বই পড়ে না, ইতিহাস বোঝে না, মাটির গন্ধ চেনে না। এরা হাঁটতে চায় না, ঘামে ভিজতে চায় না, প্রকৃতির সঙ্গে থাকতে চায় না। তারা রৌদ্রকে ভয় পায়, বৃষ্টি এড়িয়ে চলে, কাদা বা ঘাসে তাদের এলার্জি। তারা ৫০০ মিটার যেতে অর্ধ ঘণ্টা রিকশার জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা ধরে মোবাইলে ভিডিও দেখে থাকতে পারে। তাদের মানসিক গঠন এখন সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত।         যেখানে তারা নিজস্ব কোনো চিন্তা তৈরি করে না, বরং অ্যালগরিদমের পরামর্শে চিন্তা করে, ভালোবাসে, ক্ষেপে যায় এবং ঘৃণা করে।

সমাজ ও মিডিয়ার নীরব ভূমিকা

তরুণরা এই পৃথিবী বানায়নি, তারা এটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে। তাদের সংকট তাদের তৈরি নয়—এটা সমাজের ব্যর্থতার প্রতিফলন। আমরা এমন একটি সামাজিক ও মিডিয়া সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি যেখানে জনপ্রিয়তা সত্যের বিকল্প হয়ে গেছে। মিডিয়ার ভাষা এখন আর তথ্যের নয়, উত্তেজনার। টক শো-তে বিতর্ক মানে চিৎকার; নিউজ মানে নাটক; একটি ভিডিওর ভাইরাল হওয়া মানে সেটিই বাস্তবতার প্রমাণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও একই পথ অনুসরণ করছে।

জ্ঞান নয়, সার্টিফিকেটই মূল। চিন্তা নয়, “স্কোর”ই সফলতার মাপকাঠি। যেখানে এক সময় শিক্ষক ছিলেন অনুপ্রেরণা, এখন তিনি একটি “কনটেন্ট ডেলিভারি মেশিন।” এবং মিডিয়া, যেটি একসময় সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশক ছিল, আজ সেটি হয়ে উঠেছে বিনোদন-চালিত প্রোপাগান্ডার অংশ। যুবসমাজকে চিন্তা করতে শেখানোর বদলে, সেটি তাদের “ভোক্তা” করে তুলেছে।

আত্মবিচ্ছিন্নতার মানসিকতা 

এই প্রজন্মের মধ্যে যে অস্থিরতা আমরা দেখি—তার মূল উৎস হলো আত্মবিচ্ছিন্নতা (alienation)। তারা জানে না তারা কে, কোথায় যাচ্ছে, বা কেন বেঁচে আছে। তারা স্বাধীন, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন; তারা সমৃদ্ধ, কিন্তু আনন্দহীন। সারারাত জেগে অনলাইনে থাকা, সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমানো— এ যেন কেবল অভ্যাস নয়, বরং এক মানসিক অবচেতনতা। যে সময়ে সূর্যোদয় মানে ছিল নতুন সূচনা, আজ সেটি মোবাইল স্ক্রিনের আলোয় ঢাকা পড়ে গেছে।

তারা “লাইক” পেতে ভালোবাসে, কিন্তু ভালোবাসা দিতে জানে না। তারা কথা বলে, কিন্তু শোনে না। তারা জানে কীভাবে মন্তব্য করতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হয়।

শিক্ষা ও মানবিকতার ভাঙন

শিক্ষা একসময় মানুষ তৈরি করত। এখন শিক্ষা তৈরি করে “প্রোডাক্ট” – বাজারের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু জীবনের জন্য নয়। এই ব্যবস্থায় সৃজনশীলতা একটি ঝুঁকি, আর অনুকরণ একটি কৌশল। আজকের তরুণরা “জানার” চেয়ে বেশি ব্যস্ত “দেখানোর” মধ্যে। তাদের পরিচয় এখন ক্যামেরার সামনে নির্মিত হয়, বাস্তবে নয়। তারা সত্যের সন্ধান করে না, বরং অনুসরণ করে ট্রেন্ড। এবং আমরা, সমাজের প্রবীণ প্রজন্ম, তাদের শেখাইনি কিভাবে এই অস্থির পৃথিবীতে স্থির থাকা যায়।

ভবিষ্যতের পথে করণীয়

এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো— মানুষের মধ্যে আবার মানুষকে খোঁজা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা, নৈতিকতা ও নান্দনিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। শিশুদের শুধু কোডিং বা ক্যালকুলেশন নয়, সহানুভূতি ও কল্পনা শেখাতে হবে। পরিবারে কথা বলার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে— যেখানে প্রতিটি সদস্য শুধু শ্রোতা নয়, একে অপরের অনুভূতির অংশীদার। মিডিয়াকে তার “রেটিং সংস্কৃতি” থেকে বেরিয়ে এসে সত্য, চিন্তা ও মানবিক বোধ জাগানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এবং রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক, একটি সমাজের স্থিতি নির্ভর করে তার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্যের ওপর।

একটি নৈতিক পুনর্জাগরণের আহ্বান

আমাদের এখন যা দরকার তা হলো—একটি নৈতিক পুনর্জাগরণ, একটি চেতনার সংস্কার। আমরা যদি আবারও কৃতজ্ঞতা, সহমর্মিতা ও নম্রতাকে জীবনের অংশ না করি, তাহলে প্রযুক্তি আমাদের বাঁচাবে না, বরং আমাদের গ্রাস করবে। এই প্রজন্মকে দায়ী করা সহজ, কিন্তু তাদের উদ্ধার করা কঠিন— আর সেই দায়িত্ব আমাদেরই। আমরা যদি আজ মানবিক ছন্দ হারাই, আগামী প্রজন্ম শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, আত্মাহীনও হবে।

তারা জানবে কীভাবে উড়তে হয়, কিন্তু জানবে না কোথায় নামতে হয়। এখন সময় এসেছে— মানুষকে আবার মানুষ বানানোর। কারণ, পৃথিবী হয়তো আরো স্মার্ট হবে, কিন্তু যদি তার আত্মা হারায়, তবে তার কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। এই প্রবন্ধ কোনো দেশের নয়, কোনো প্রজন্মের নয়—এটা আমাদের সবার কথা। আমরা যে মানবিকতা হারাচ্ছি, সেটাই আমাদের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অস্তিত্বগত সঙ্কট।

যদি আমরা এখনই আত্মসমালোচনার সাহস না দেখাই, তাহলে ইতিহাস শুধু অতীতের নয়, আমাদের ভবিষ্যতেরও বিচার করবে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

২২ বছর পর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়

২২ বছর পর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়

ক্লাউডফ্লেয়ার ডাউন: বাংলাদেশি গণমাধ্যমসহ বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিপর্যয়

ক্লাউডফ্লেয়ার ডাউন: বাংলাদেশি গণমাধ্যমসহ বিশ্বের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিপর্যয়

একদিনে ডেঙ্গুতে ৪ মৃত্যু, আক্রান্ত ৯২০

একদিনে ডেঙ্গুতে ৪ মৃত্যু, আক্রান্ত ৯২০

যে কারণে মুশফিককে ‘কিংবদন্তি’ বললেন ফিল সিমন্স

যে কারণে মুশফিককে ‘কিংবদন্তি’ বললেন ফিল সিমন্স

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App