×

ভ্রমণ

প্রেম, প্রকৃতি ও অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ

৪০ বছর আগে ইউরোপে দুই বন্ধুর শরৎকালীন ট্রেন ভ্রমণ

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৭ পিএম

৪০ বছর আগে ইউরোপে দুই বন্ধুর শরৎকালীন ট্রেন ভ্রমণ

ইউরোপের দেশ সুজারল্যান্ডের জুরিখ শহর। ইনসেটে লেখক রহমান মৃধার পুরাতন ছবি

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ইউরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু এরিক। আমরা পরিকল্পনা করেছি ট্রেনে ভ্রমণ করব, রাতে ট্রেনে ঘুম এবং দিনে শহরের বিভিন্ন স্থানের দর্শন। সেই সময় ছিল শরৎ, “Allhelgonadagen” বা “All Saints’ Day”, খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের একটি উৎসব, যখন মানুষ প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মরণ করে, কবরস্থানে মোমবাতি জ্বালায় এবং পরিবারসহ নিরিবিলি সময় কাটায়।

ডর্মিটরিতে শুধু আমি আর এরিক ছিলাম; সকল সুইডিশ শিক্ষার্থীর কেউ ছুটিতে, কেউ বাড়িতে চলে গেছে। নির্জনতা আর ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে হুট করে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ট্রেন ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ব। আমাদের গন্তব্য: জার্মান, ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্স। সময় দুই সপ্তাহ, এবং রাতের ট্রেনে ঘুম, দিনে শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা, এই ছিল ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য।

এরিক অ্যামেরিকা থেকে এসেছে সুইডেনে, কারণ তার পিতামহ ১৮শ শতকে সুইডেন ছেড়ে আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এরিক এসেছে তার পূর্বপুরুষের রুট জানতে। সে আমার ডর্মিটরিতে থাকে, এক বছরের কোর্সে নর্ডিক ইতিহাস পড়ছে।

লিনশোপিং থেকে রাতের ট্রেনে আমরা রওনা হলাম ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের উদ্দেশ্যে। সম্ভবত মিডনাইটে পৌঁছলাম কোপেনহেগেনে, কিন্তু আমরা নামিনি; উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির হামবুর্গে পৌঁছে প্রথম ব্রেক নেওয়া। ট্রেনের বগিতে দু’জন বন্ধু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ট্রেন থেমে গেল। আনাউন্সমেন্ট শুনে জানলাম ট্রেন হামবুর্গ পৌঁছে গিয়েছে।

হামবুর্গ (দিন ১)

সকাল সাতটায় ট্রেন হামবুর্গে ঢুকে পড়ল। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নামতেই হালকা ধোঁয়াটে ভোরের আলো শহরকে অর্ধচ্ছায়ায় ভিজিয়ে রেখেছে। ঠাণ্ডা শরতের হাওয়া মুখে লেগে গেল, একধরনের সতেজ, নদীর আর্দ্রতা মিশে থাকা হাওয়া। আমাদের সঙ্গে ছিল একটি ryggsäck, সুইডিশ শব্দটির অর্থ পিঠব্যাগ বা ব্যাকপ্যাক। সেটি স্টেশনের লকারে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ব্রেকফাস্টের খোঁজে। ব্রেকফাস্ট শেষে শহর ঘুরতে বের হলাম, হামবুর্গের চারপাশে, এক নতুন শহর, এক অচেনা অনুভূতি নিয়ে।

রাস্তার ধারে ছোট ছোট ক্যাফি শপগুলোতে ভোরের কফি মিশে যাওয়া রুটি-ব্রেডের সুগন্ধ। মানুষজন ধীরে ধীরে রাস্তায় বেরোচ্ছে, কেউ হালকা পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছে, কেউ নদীর ধারে প্রকৃতির মাঝে রৌদ্র খুঁজছে। রেপারবান এলাকার অলিগলিতে বেজে উঠছে ব্যান্ডের প্র্যাকটিসের আওয়াজ, যেন শহরের হৃদয় নিজেই কিছুটা সংগীতময় হয়ে উঠেছে।

আমরা হাঁটছিলাম এলব নদীর ধারে। জেলেদের নৌকা ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করছে, আর দূরে বড় বড় কন্টেইনার জাহাজ এসে যাচ্ছে। নদীর ওপর ভোরের আলো পড়ছে, একদম সোনালি ছায়া। পাখির ডাক, জাহাজের দূরের আওয়াজ, মানুষের ছোট ছোট আলাপ, দেখে মনে হলো শহর ধীরে ধীরে জীবন্ত হচ্ছে।

দুপুরে আমরা শহরের পুরনো এলাকায় ঢুকলাম। সরু পাথরের রাস্তায় ছোট ছোট দোকান, স্থানীয় বেকারির সুগন্ধ আর সসেজের ভাজার ধোঁয়া। রাস্তার পাশে ছোট কাগজের প্যাকেটে স্থানীয় চিজ কিনে খাওয়া, মুখে মাখামাখি, আর মন যেন শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। রাস্তার বাচ্চাদের খেলা, দোকানিদের চিৎকার, যেন শহর আমাদের গল্প বলছে।

সন্ধ্যা হলে আমরা হালকা নৌকা ভ্রমণে এলব নদীতে একটু ঘুরলাম। সূর্য ডোবা শুরু করছে, নদীর জলে প্রতিফলিত লাল-কমলা আকাশ, নদীর ধারের বাতাসের ঠাণ্ডা শিরায় লাগছে। সন্ধ্যার হালকা কোলাহলে শহরটি যেন অন্য রূপে ভেসে উঠছে, চলতি জাহাজের ধ্বনি, নৌকার বাতি, নদীর ওপর হালকা কুয়াশা।

রাতের দিকে, রেপারবান এলাকায় ছোট্ট বার এবং ক্লাবে গেলাম। সঙ্গীতের আওয়াজ, মানুষের হেসে খেলা, হাতের গ্লাসের শব্দ, শরতের হামবুর্গ শহরের রাত আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। রাতের আকাশের তারা, শহরের আলো, মানুষের গল্প, সবই মনে করিয়ে দিচ্ছে, একদিনের এই ভ্রমণ শুধু চলাচল নয়, বরং শহরের জীবন অনুভবের অভিজ্ঞতা।

১৯৮৫ সালের শরতের হামবুর্গ যেন জার্মানির হৃদয়ে ইতিহাস, শিল্প ও পুনর্জন্মের এক অনন্য মেলবন্ধন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন এখনও চোখে পড়ে, কিন্তু শহর নিজেকে নতুন স্বপ্নে গড়ে তুলেছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়।

আমরা দুজন তরুণ, হাতে অল্প সময়। মনে হচ্ছিল আমরা এক প্রজন্মের প্রতীক, যারা কৌতূহল, শিক্ষা এবং স্বাধীনতার খোঁজে রওনা হয়েছে। তখনও বুঝিনি, আমরা এক পরিবর্তনশীল ইউরোপের সাক্ষী, যেখানে যুদ্ধের ছায়া মিলিয়ে জন্ম নিচ্ছিল নতুন বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব।

এটি ছিল এক শিক্ষা: শহর পুনর্গঠন মানে শুধু ভবন নয়, মানুষের মনও নতুন করে গড়ে ওঠে। আমরা যা দেখছি, সেই সব প্রাচীন গলি, নদীর ধারে কফি খাওয়া মানুষ, ছোট্ট দোকান, সবকিছু যেন শোনাচ্ছে অতীত ও বর্তমানের গল্প।

জার্মান শহরের হামবুর্গ থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ (দিন ২)

রাতের ট্রেনে হামবুর্গ ছেড়ে আমরা দক্ষিণের পথে রওনা দিলাম। ট্রেন ধীর গতিতে চলতে শুরু করলে জানালার বাইরে শহরের আলো ছোট ছোট রোদমাখা নক্ষত্রের মতো ঝলমল করছিল। কক্ষের ভেতর হালকা আলো, আমাদের ব্যাগের পাশে পানির বোতল, আর ধীর ধীর বাজতে থাকা রেললাইন, সব কিছু মিলিয়ে যেন এক শান্তি।

জানালার বাইরে হঠাৎ চওড়া সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে ছোট গ্রাম, গরু এবং ভেড়ার ঝাঁক, দূরে লাল ছাদের ছোট বাড়ি। ট্রেনের ধোঁয়ায় মিশে থাকা ধূসর আকাশ, নদীর ধারে সোনালি প্রতিফলন, সবই মনে করিয়ে দেয় পথচলার সৌন্দর্য। আমরা চুপচাপ বসে দেখছিলাম, মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসি। রাত জুড়ে এই চক্রাকার দৃশ্য, ট্রেনের দোতলা হালকা কাঁপন, সিগন্যালের আওয়াজ, রাত তবে তেমন অন্ধকার না, তবুও হালকা পাতলা ঘুমের ঘোরে মনে হলো জীবন যেন এক দীর্ঘ গল্প।

সকালবেলা ট্রেন জুরিখ স্টেশনে ঢুকল। ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে লেগে গেছে, সুইজারল্যান্ডের শরতের হালকা শীত। আমরা ব্যাগ নিয়ে বের হলাম, শহরের রাস্তা ইতিমধ্যেই মানুষের কোলাহলে ভরে গেছে।

প্রথমেই নদী লিম্মাতের ধারে হাঁটলাম। নদীর জল তুষারাক্ত আল্পসের থেকে নেমে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঝকঝকে। জাহাজ ছোট ছোট ঢেউ তুলছে, নদীর পাড়ে হাঁটা মানুষ, কুকুর হাঁটাচলা, স্থানীয় বেচারাদের ছোট বাজার, শহর যেন জীবন্ত।

পুরনো শহরের সরু গলিগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, পাথরের প্রতিটি ধাপ যেন ইতিহাস বয়ে আনে। ছোট্ট ক্যাফেতে বসে হালকা কফি আর পেস্ট্রি খাওয়া, চোখে নদীর জল, চোখের কোণে পুরনো বাড়ির দেয়াল, আর বাতাসে আর্কিটেকচারের সুবাস। শহরের বাজারে রঙিন ফল, স্থানীয় চিজ, বেকারির তাজা রুটি, সবই আনন্দের ছোট ছোট মুহূর্ত।

দুপুরে আমরা লিম্মাত নদীর সাঁকো দিয়ে পার হলাম। নদীর জলে সূর্যের প্রতিফলন, দূরে ছোট নৌকা, নদীর ওপারে ছায়া ফেলা পুরনো ঘরগুলো, দেখে মনে হলো যেন শহর আমাদের গল্প বলছে। শিশুদের খেলাধুলা, বয়স্কদের আলাপ, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি, এর সবই জুরিখের প্রতিটি মুহূর্তকে করে তোলে প্রাণবন্ত।

সন্ধ্যা হলে আমরা ছোট একটি হোস্টেলে উঠলাম। জানালার বাইরে পাহাড়ের ছায়া, শহরের আলো মিশে এক মৃদু জ্বলজ্বলে দৃশ্য তৈরি করছে। হালকা বাতাসে ঠাণ্ডা হাওয়া, আর ভিতরে হালকা বাতি, যা দিনের ক্লান্তি সরিয়ে মনের শান্তি এবং জীবনের মিশ্র অনুভূতি ফিরিয়ে দিল। সারাদিনের স্মৃতিচারণ রাতের দিকে, নদীর ধারে বসে হালকা হেঁটে বেড়ানো, স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়া, আর মানুষের ছোট ছোট গল্প শোনা, বলা যেতে পারে জুরিখ শুধু দেখা নয়, অনুভবের শহর।

জুরিখ থেকে লুসার্ন ও ইন্টারলাকেন (দিন ৩)

জুরিখের সকালে আমরা আবার ট্রেনে উঠলাম। জানালার বাইরে, শহরের পুরনো বাড়ি আর আল্পসের ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড় একসাথে মিলেমিশে একটি শান্তিপূর্ণ দৃশ্য উপস্থাপন করছে। ট্রেন ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে ছোট গ্রামগুলো, লাল ছাদের ছোট্ট বাড়ি, মাঠে ঘাসের উপর পড়া সূর্য, সবই যেন এক লাইভ ছবি। মাঝে মাঝে লম্বা সেতু দিয়ে নদী পার হলাম, নদীর ঠাণ্ডা জল ধীরে ধীরে ট্রেনের গতিতে কেমন ঝাপসা রূপ নিল।

রাতের মতো নয়, কিন্তু দিনের হালকা আলোও নদী, পাহাড়, বন এবং সবুজ মাঠকে জীবন্ত করে তুলছে। আমরা জানালার পাশে বসে চুপচাপ, একে অপরের দিকে তাকিয়ে না বলেও বুঝছিলাম, এই দৃশ্য আমাদের মনে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।

প্রসন্ন মন নিয়ে লুসার্ন স্টেশনে নামলাম। হালকা ধোঁয়া, ফোটা ফোটা রোদ, পাহাড়ের ছায়া, সবই শহরকে এক রহস্যময় রূপে সাজাচ্ছে। আমরা নদীর ধারে হাঁটতে শুরু করলাম। শহর ছোট, কিন্তু চোখে পড়ছে ইতিহাসের গভীরতা। কাঠের পুরনো সেতু, চারপাশে ছোট ঘর, এবং নদীর শান্ত জল, এক শান্তি এবং বিস্ময় অনুভূতি।

বাজারে হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় চিজ, বেকারির রুটি, বাদামের ছোট দোকান, সবই চোখে ধরা পড়ল। পথের ধারে বাচ্চারা হেসে খেলছে, বয়স্করা গল্প করছে, আর সবুজ পাহাড়ের পেছনে হালকা কুয়াশা ভেসে যাচ্ছে। শহরের বাতাসে ইতিহাসের সুবাস, নদীর ঢেউ এবং লোকের হাসি, লুসার্ন যেন নিজেই এক জীবন্ত গল্প।

রাতের দিকে, ছোট হোটেলে উঠলাম। জানালার বাইরে লেকের পানি চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। শহরের বাতি আর পাহাড়ের ছায়া একত্রে এক মৃদু, স্বপ্নময় দৃশ্য তৈরি করছে। আমরা বিছানায় ঘুমের ঘোরে ক্লান্ত স্বরে কথা বলছি দিনে কী করলাম। নদীর ধারে হেঁটেছি, স্থানীয় খাবার খেয়েছি, মনে হলো শহরের সৌন্দর্য শুধু চোখে নয়, মনেও গেঁথে গেছে।

ইন্টারলাকেন (দিন ৪)

পরের দিন সকালে ট্রেনে উঠে ইন্টারলাকেনের পথে। জানালার বাইরে, লেক থুন ও লেক ব্রিয়েঞ্জের শান্ত জল, দূরে আল্পসের সাদা চূড়া, সবই যেন আমাদের স্বপ্নের মতো দৃশ্য। ট্রেনের ধোঁয়া-ধূসর বাষ্প, পাখির ডাক, দূরে ছোট গ্রাম, জীবন যেন এক শান্তিপূর্ণ সুরের মতো।

ইন্টারলাকেনে পৌঁছে আমরা পাহাড়ের দিকে হাঁটলাম। আল্পসের তুষার ঢাকা চূড়া, ছোট ছোট ঝর্ণা, লেকের পাশে বসা, এক বিস্ময়কর প্রশান্তি। ছোট্ট কেবিনে রাত কাটিয়ে মনে হলো এই ভ্রমণ শুধু চলাচল নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে সময়ের গল্প। শান্তি, বিস্ময় এবং বন্ধুত্ব, যা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

ইতালি-মিলান, ফ্লোরেন্স, রোম (দিন ৫-৭)

মিলান

সকালবেলা জুরিখ থেকে ট্রেনে চড়ে আমরা দক্ষিণের দিকে নেমে মিলানের দিকে চললাম। জানালার বাইরে নদী, ছোট গ্রাম, শীতল বাতাস, সব মিলিয়ে যেন পথচলা নিজেই এক জীবন্ত চিত্র। দুপুরের দিকে ট্রেন ধীরে ধীরে মিলান স্টেশনে ঢুকল।

মিলান, শহরটি যেন এক জীবন্ত মেলবন্ধন: শিল্প, ফ্যাশন, ইতিহাস, সঙ্গীত। Duomo di Milano-এর সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম। মানুষের হেসে খেলা, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ, বয়স্কদের গল্প, সবই শহরের হৃদয়। রাস্তার ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে আমরা শহরের ছোট ছোট মুহূর্ত উপভোগ করলাম: দোকানদারের চিৎকার, সাইকেল ঘণ্টাধ্বনি, রাস্তায় দৌড়ঝাঁপ করা মানুষ।

রাতের ট্রেনে চড়ে ফ্লোরেন্সের পথে রওনা দিলাম। জানালার বাইরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, লাল-কমলা আকাশের প্রতিফলন নদী ও মাঠে পড়ছে। ট্রেনের ধোঁয়া ও হালকা দোল, রাতের যাত্রা যেন এক স্বপ্নময় সময়।

ফ্লোরেন্স

ফ্লোরেন্স স্টেশনে পৌঁছে আমরা শহরের সরু গলি এবং রঙিন বাজারের দিকে হাঁটলাম। আর্কিটেকচারের প্রতিটি খুঁটিনাটি, পাথরের রাস্তার প্রতিটি দাপ, সবই ইতিহাসের গল্প বলছে। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় বসে হালকা পাস্তা, রিসোট্টো খেয়ে শহরের সৌন্দর্য আরও মুগ্ধকর মনে হলো।

আর্ট গ্যালারি, পুরনো চার্চ, ছোট্ট সেন্ট্রাল স্কোয়ারে বসে মানুষ দেখার মজা, শহর যেন জীবন্ত। সন্ধ্যা হলে আরনো নদীর ধারে হেঁটে নদীর প্রতিফলন দেখলাম, শহরের বাতি ও সূর্য ডোবার আলো এক অদ্ভুত শান্তি তৈরি করছে।

রাতের ট্রেনে উঠে রোমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। জানালার বাইরে পাহাড়, ছোট গ্রাম, বাগান, মাঝে মাঝে লাল ছাদের বাড়ি, সবই আমাদের চোখে জীবন্ত চিত্র।

রোম

রোম স্টেশনে নামার পর শহরের বাতাসেই ইতিহাসের গন্ধ। কলোসিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাচীন সভ্যতার প্রতিধ্বনি শুনলাম। দূরে ফোরাম রোমানাম, ছোট বৃত্তাকার গলি, রাস্তায় স্থানীয়দের হেঁটে চলা, মনে হলো শহর নিজেই কথা বলছে।

ট্রেভি ফাউন্টেনে কয়েন ছুঁড়ে চুপচাপ ইচ্ছা করলাম, হয়তো একদিন আবার ফিরব। ছোট ক্যাফেতে রাত কাটিয়ে হাতে কফি, পাশে বাজছে পুরনো ইতালীয় গান। মানুষের হেসে খেলা, দোকানদারের চিৎকার, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ, রোম্যান্টিক শহরের রাত জীবন্ত।

রোম থেকে ভোরে ট্রেনে উঠে আমরা স্পেনের বার্সেলোনার পথে চললাম। জানালার বাইরে সূর্যের নরম আলো, পাহাড়, ছোট গ্রাম, এ যেন এক স্বপ্নময় যাত্রা।

বার্সেলোনা ও স্পেন, চমৎকার অভিজ্ঞতা (দিন ৮-৯)

১৯৮৫ সালে স্পেন তখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাঝপথে ছিল। ১৯৭৫ সালে ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু এবং পরবর্তী গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পর দেশ ধীরে ধীরে নতুন আত্মবিশ্বাসে ফুটে উঠছিল। বার্সেলোনা, কাতালোনিয়ার প্রাণকেন্দ্র, তখন কাতালান ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার অনুভূতি পুনর্জীবিত করার প্রক্রিয়ায় ছিল।

সকালবেলায় রোম থেকে ট্রেনে উঠে আমরা দক্ষিণের আকাশের নরম রোদে জানালার বাইরে দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। পাহাড়, লাল ছাদের ঘর, ছোট গ্রাম, সব মিলিয়ে মনে হলো ট্রেনের দোল আমাদের সময়ের ধারার সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে।

বার্সেলোনায় পৌঁছে শহরের রঙিন রাস্তায় ঢুকতেই চোখে পড়ল শহরের প্রাণ:

  •    রঙিন পতাকা, পোস্টার, কাতালান ভাষার লেখা, শহরের পুনর্জাগরণ অনুভূত হলো।

  •    রাস্তার শিল্পী, ব্যান্ডের সঙ্গীত, ছোট বাজার, ক্যাফি শপ, রেস্তোরাঁ, সবই শহরের জীবনকে বর্ণনা করছে।

  •    শহরের দিনকাল: সকাল থেকে শহর প্রাণে ভরে যায়; বাজারে তাজা সবজি, ফল, চিজ, স্থানীয় খাবারের ঘ্রাণ। রাস্তায় শিশুদের খেলা, দোকানিদের চিৎকার, পথচারীদের হাঁটাহাঁটি, যেখানে শহরের জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠছে।

দুপুরে আমরা গাউডির স্থাপত্য ঘুরে দেখলাম, সাগ্রাদা ফামিলিয়া, পার্ক গুয়েল। বাঁকা রঙিন দেয়াল, সূক্ষ্ম মূর্তিকলা, জটিল নকশার ছাদ, সবই শিল্প ও ইতিহাসের এক অনন্য সংমিশ্রণ। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় বসে টাপাস, তাজা মাছের খাবার, পায়েলা খাওয়া, মুখে স্বাদ, চোখে শহরের দৃশ্য, কানায় রাস্তার আওয়াজ, সব কিছু ছিল অভিজ্ঞতা পূর্ণ।

সন্ধ্যায় নদীর ধারে হেঁটে চলতে চলতে শহরের রাতের চিত্র ফুটে উঠল:

  •    রঙিন আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছে, দূরে বাজছে গিটার বা স্থানীয় সংগীত।

  •    রাস্তার শিল্পী, সঙ্গীতের ছন্দ, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ, পথচারীদের হাসি, সব মিলিয়ে রাতের বার্সেলোনা জীবন্ত।

পর্যটকের দৃষ্টিকোণ:

১৯৮৫ সালে পর্যটকরা শহরের ঐতিহাসিক স্থাপত্য, নদীর ধারে হাঁটা, স্থানীয় খাবার এবং শহরের প্রাণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ অনুভব করতেন। শহরের পরিবেশ ও সামাজিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের সঙ্গে মিলেমিশে তারা শুধু পর্যটক নয়, অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে উঠতেন।

রাতের দিকে আমরা ট্রেনে উঠে দক্ষিণ ফ্রান্সের পথে রওনা দিলাম। জানালার বাইরে সমুদ্র, পাহাড়, ছোট গ্রাম, মনে হলো আমরা যেন একটি চলন্ত চিত্রকল্পের অংশ। ট্রেনের ধীর দোল, লোহার রেললাইন দিয়ে আওয়াজ, বাতাসের হালকা স্পর্শ, রাতের যাত্রা এক ধরণের শান্তি, স্বপ্নময়তা এবং অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি।

দক্ষিণ ফ্রান্স (দিন ১০)

বার্সেলোনা থেকে ট্রেনে চড়েই আমরা দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট শহর ও গ্রাম অতিক্রম করছিলাম। জানালার বাইরে প্রকৃতির দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রকল্প: আলপাইন পাহাড়ের নরম ঢাল, সোনালি আকাশের নিচে স্নিগ্ধ সবুজ বন, মাঝে মাঝে লাল-ছাদের ছোট্ট গ্রাম। নদীর ধারে ভেসে আসা হালকা কুয়াশা, মাঠে কাজ করা কৃষক এবং পথের ধারে ছোট দোকান, মনে হলো ট্রেনের যাত্রা যেন জীবন্ত ছবি।

শহরগুলোতে পৌঁছে দিনের ভ্রমণ শুরু হলো।

  •    বাজার ও রাস্তা: সকালে বাজারে বিক্রি হচ্ছে তাজা সবজি, ফল, চিজ, ওলিভ, স্থানীয় পেস্ট্রি। মানুষ হেসে আলাপ করছে, শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, পথচারীদের হাঁটাহাঁটি, যেন শহরের জীবন্ত ছবি ফুটে উঠছে।

  •    স্থানীয় খাবার ও সংস্কৃতি: রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া হলো প্রদেশের বিশেষ ডিশ, রাতের পায়েলা, মলাসা ভাজা, স্থানীয় মাংসের স্যুপ। কফি শপে বসে স্থানীয়রা খবর পড়ছে, বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছে।

  •    শহরের সৌন্দর্য: পুরনো গলিপথ, পাথরের বাড়ি, রঙিন জানালা, ছোট বাগান, মনে হলো আমরা সময়ের সঙ্গে শহরের ইতিহাসের সঙ্গেও হাঁটছি।

সন্ধ্যা হতে হতে শহরের আলো নদীতে প্রতিফলিত হচ্ছে। রাস্তার শিল্পী গিটার বাজাচ্ছে, দূর থেকে স্থানীয় সংগীত, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ, রাতের দক্ষিণ ফ্রান্স যেন এক জীবন্ত নাট্যচিত্র।

রাতের ট্রেনে উঠে আমরা প্যারিসের উদ্দেশ্যে চললাম। জানালার বাইরে পাহাড়, সমুদ্র, ছোট গ্রাম, হালকা কুয়াশা, রাতের যাত্রা এক ধরণের স্বপ্নময়তা ও শান্তির সঙ্গে ভরা।

প্যারিস (দিন ১১)

সকালবেলায় প্যারিস পৌঁছেই আমরা শহরের প্রাণে নিমগ্ন হলাম। প্যারিস তখনো ১৯৮৫ সালের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাঝপথে। নদী, রাস্তা, বাজার, আর রাস্তায় হাঁটতে থাকা মানুষ, শহরের জীবন্ত দৃশ্য ফুটে উঠছে।

  •    সেন নদী ও ৩২টি সাঁকো: শহরের বিভিন্ন সাঁকো পার হয়ে নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিফলিত আলো, নৌকা চলার শব্দ, দূর থেকে বাজছে সঙ্গীত, প্যারিস যেন জীবন্ত চিত্রকল্প। বিশেষ করে পন্ট ন্যুফের প্রতিফলন চোখকে মুগ্ধ করে।

  •    আইফেল টাওয়ার: দুপুরে পৌঁছে তার আয়তন, লোহার জালিকৃত কাঠামো এবং চারপাশের পার্ক আমাদের মুগ্ধ করে। স্থানীয়রা ফটোগ্রাফ তুলছে, পর্যটকরা চূড়ায় ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে।

  •    লুভর ও মোনালিসা: পুরনো রাজার প্রাসাদ এবং লুভরে ঢুকে মোনালিসার রহস্যময় হাসি দেখলাম। প্রতিটি চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও প্রদর্শনী যেন ১৯৮৫ সালের প্যারিসের সংস্কৃতির নিদর্শন।

শহরের রঙিন রাস্তা, ক্যাফে, দোকান, শিশুদের খেলা, বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ, স্থানীয় মানুষদের হেসে খেলে আড্ডা, রাতের প্যারিস এক জীবন্ত চিত্র।

হঠাৎ আমাদের পাশ দিয়ে কয়েকজন মেয়ে হেঁটে চলে গেল। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হলো চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন তারে দেখেছি। মনে হচ্ছে এই বুঝি কাছে এলো। তাহলে কি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে? আমি যার কথা ভাবছি সে নয় কি? কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিনের চেনা! আমি দাড়িয়ে তার পেছনটি দেখছি আর ভাবছি হয়তো পিছনে তাকিয়ে দেখবে আমাকে, যেমনটি আমি দেখছি তাকে। আমাকে মনে হয় ভিমরতিতে ধরেছে, বয়স তেমন বেশি না তখন তবে শুনেছি বয়স হলে এমনটি হয়, কিন্তু বয়স তখন খুব একটা বেশি হয়নি! চোখদুটি একটু চুলকাতে চুলকাতে আমি আমার গন্তব্যস্থলে হাঁটতে শুরু করলাম। এদিকে মনের মধ্যে প্রশ্ন এলো কে সেই সুন্দর কে?

সারাদিন হেঁটেছি অনেক, ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছিল, তবে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে হবে, কিছুই মিস করা চলবে না। রাতে ঢুকে পড়লাম ক্যাফি শপে। দুই বন্ধু, নাদুস নুদুস চেহারা, তবে খারাপ লাগছে না, কারণ সমবয়সী মেয়েদের আড্ডা জমেছে। আড় নজরে তাকাতাকি চলছে। হঠাৎ এরিক বললো, রহমান, একটি মেয়ে তোমাকে নিয়ে মনে হচ্ছে তার বান্ধবীদের সঙ্গে কিছু বলাবলি করছে। আমি তাদের দিকে তাকাইনি, বরং এরিককে বললাম, আমি এই প্রথম প্যারিসে, আমার সঙ্গে কারো কোনো সম্পর্ক বা চেনাজানা তো হতেই পারে না। তুই নিশ্চিত ভুল ভাবছিস অথবা মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্টিং করছিস? এরিক বললো, দোস্ত, একটু ঘুরে দেখ, আমি সত্যিই বলছি। ইউরোপে নতুন ঢুকেছি, দেশে থাকতেও খুব প্রেম-প্রীতি হয়নি, মাঝে মধ্যে চিঠি পত্র লিখেছি। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে কী ইউরোপে প্রেম করা যায়? চিঠির প্রেম তো এখানে নেই হয়ে গেছে সেই হজরত আদম (আঃ)-এর সময়।

একটু ঘুরে ফিরতেই চমকে উঠলাম, কে সেই সুন্দরী? আমি তাকাতেই সে চিৎকার করে উঠল, রহমান? What are you doing here and how long have you been here? আমি  কিছু বলার সময় পেলাম না, ইতিমধ্যেই সে কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো।

ক্লাওডিয়া, সুইজারল্যান্ডের মেয়ে। তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল স্টকহোমের একটি ম্যাকডোনাল্ডে। আমি আগে লিখেছি, সুইডেনের প্রথম আগমন এবং স্টকহোমে ম্যাকডোনাল্ডে কয়েক ঘণ্টার চাকরির অভিজ্ঞতা। ক্লাওডিয়া ঠিক সেই সময়ে সামার জব করতে স্টকহোমে গিয়েছিল। ওই ছিল আমার শিক্ষাগুরু, আমি সেদিন যে সময়টুকু কাজ করেছিলাম সেই ম্যাকডোনাল্ডে। সামার শেষে সেও ফিরে যায় তার দেশে। কথোপকথনে জানা যায়, সে বান্ধবীদের সঙ্গে প্যারিস ভ্রমণে এসেছে।

আমি কয়েক ঘণ্টা আগে যাকে চলতি পথে দেখেছিলাম, সেই ছিল এই মেয়েটি, কিন্তু সে আমাকে দেখেনি। হঠাৎ দেখা হয়েছিল সেই ক্ষণে, দুজনে দুজনার। খুব সকালে উঠতে হবে, তারপরও গভীর রাত পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে প্যারিসের ক্যাফে শপে স্মৃতিচারণ করি সেই ম্যাকডোনাল্ডের স্বল্পসময় নিয়ে। যাবার বেলায় হাত দুটো ধরে বলেছিল, যোগাযোগ করো। বিদায়ের সময় বেশ আপ্লুত ছিলাম, জানিনে বন্ধুত্ব নাকি অনুভূতিতে ভালোবাসাও ছিল!

ভ্রমণের শেষ দিন, ফিরতে হবে। ভোরের ট্রেনে উঠে পরবর্তী গন্তব্যে স্থান হামবুর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। জানালার বাইরে শহরের আলো, নদী, ছোট গ্রাম, সব মিলিয়ে মনে হলো আমরা এক চলন্ত চিত্রকল্পের অংশ। ট্রেনের ধীর দোল, লোহার রেললাইন দিয়ে আওয়াজ এবং হালকা বাতাস, সব কিছু মিলি রাতের যাত্রা স্বপ্নময় ও প্রশান্তিময় অভিজ্ঞতা তৈরি করছে। ট্রেনে উঠে আমরা জানালার দিকে তাকাই। শহরের ছাদ, রাস্তার মানুষ, দূরে পাহাড়ের ছায়া ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন উত্তরের দিকে ছুটছে। জানালার বাইরে ঝরে পড়া সোনালি পাতা, ছোট গ্রাম আর নদীর ধারা যেন আমাদের জন্য আলাদা করে গল্প বলছে। ঠিক সেই সময় ক্লাওডিয়াকে মনে পড়ল, সেই অদ্ভুত হঠাৎ সাক্ষাৎ, উচ্ছ্বাস আর ছোট্ট আলাপন।

প্রায় ছয় ঘণ্টার যাত্রার পর হামবুর্গে পৌঁছলাম। স্টেশনে নামার সঙ্গে সঙ্গে শহরের ব্যস্ততা আর কুয়াশা মিশ্রিত ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ব্যাগ কাঁধে তুলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, এই দশ-এগারো দিনের যাত্রা শুধু স্থানান্তর নয়, এটি এক অভিজ্ঞতার খনন, ইতিহাস, প্রকৃতি, শিল্প আর মানুষের নানা রঙের এক শিক্ষা।

আমরা দুজন একসাথে হাঁটছিলাম স্টেশনের বাইরে। পেছনে ছিল প্যারিস, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড আর ইতালির স্মৃতি; সামনে হামবুর্গ, যেখান থেকে আমরা ট্রেনে করে স্টকহোমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সুইডেনে ফিরে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

হঠাৎ একদিন ডর্মিটরির টেলিফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই বলল, হাই ক্লাওডিয়া বলছি, তোমাকে আমার মনে পড়েছে। আমি শুনতে পেলাম তার কণ্ঠের উচ্ছ্বাস, সেই আন্তরিক উষ্ণতা যা কেবল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পাওয়া যায়। কথা বলার সময় মনে হলো, দূরত্বের কোনো শক্তি এই বন্ধুত্বের উষ্ণতা কমাতে পারবে না। আমরা কয়েক মিনিট চুপচাপ একে অপরের কথা শুনলাম, তারপর সে বলল, বলো না আবার কবে দেখা হবে?

আমাদের যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত, রাতের ট্রেনের ধোঁয়াচ্ছন্ন আলো, রাস্তার মানুষদের ছোট ছোট আড্ডা, ক্যাফি শপের গরম আলো ও সুগন্ধ, পাহাড়ের নীরবতা, নদীর ঢেউ, আকাশে সূর্যাস্তের লাল ও সোনালি রঙ, সব কিছু মনে হয়েছিল প্রতিটি মুহূর্ত স্মৃতির সঙ্গে মিশে গেছে।

বন্ধুত্ব, আবেগ, শহরের সৌন্দর্য, প্রতিটি মুহূর্তের ছোটখাটো খোঁজ, অভিজ্ঞতার ভিড়ে এই ভ্রমণ হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত স্মৃতি, যা হঠাৎ এত বছর পর মনে করিয়ে দিল, যেন সেই নজরুল ইসলামের ‘আজও মধুর বাঁশরী বাজে। গোধূলি লগনে বুকের মাঝে মধুর বাঁশরী বাজে।’ ট্রেনের ধোঁয়াচ্ছন্ন আলো, রাস্তার মানুষদের ছোট ছোট আড্ডা, ক্যাফি শপের গরম আলো ও সুগন্ধ, পাহাড়ের নীরবতা, নদীর ঢেউ, সব মিলিয়ে মনে হলো সময় যেন স্থির হয়ে আমাদের গল্প শোনাচ্ছে। বন্ধুত্ব, আবেগ এবং প্রতিটি মুহূর্তের সৌন্দর্য একত্রে একটি চিরন্তন অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল, যা আজও স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। ক্লাওডিয়ার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। এরিক পরবর্তীতে আমেরিকাতে ফিরে যায়, সময়ের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু স্মৃতিগুলো হৃদয়ে গেঁথে আছে।

লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

এফআইসিসিআই সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল রবি

এফআইসিসিআই সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেল রবি

‘শিল্প-সাহিত্যে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আসতে হবে’

‘শিল্প-সাহিত্যে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আসতে হবে’

জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের সাধারণ অধিবেশন ২৫ নভেম্বর

জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের সাধারণ অধিবেশন ২৫ নভেম্বর

৪০ বছর আগে ইউরোপে দুই বন্ধুর শরৎকালীন ট্রেন ভ্রমণ

প্রেম, প্রকৃতি ও অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ ৪০ বছর আগে ইউরোপে দুই বন্ধুর শরৎকালীন ট্রেন ভ্রমণ

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App