নৈরাজ্য
ঢাকার সড়কে সবাই রাজা
দেব দুলাল মিত্র
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৭ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
‘নিরাপদ সড়কের’ স্লোগান শুধুই কাগজে-কলমে। দেশের সড়ক-মহাসড়কের কোথাও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। খোদ রাজধানীর সড়কে চলছে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। এখানে কেউ শুনে না কারো কথা; সবাই চলে ইচ্ছেমত। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের এই সীমাহীন অনিয়ম কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলছে। কাজীর গরু যেমন শুধু কেতাবেই থাকে, গোয়ালে খুঁজে পাওয়া যায় না- তেমনি সড়ক আইন, সড়কের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা এখন কেতাবেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে প্রয়োগের দেখা মেলে না। যাদের আইন মানার কথা তারা আইন ভাঙ্গার ক্ষেত্রে যেমন বেটপরোয়া; তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদাসীন। উভয় দিকের এই দায়িত্বহঅন আচরণের কারণে রাজধানীর সড়কে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা, বেড়েছে নৈরাজ্য।
সড়ক জুড়ে বিশৃঙ্খলা : ঢাকা মহানগরীর সড়ক জুড়ে বিশৃঙ্খলা আগের চেয়ে বেড়েছে। চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও আইন ভাঙ্গার প্রবণতা এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই নিয়মের মধ্যে ফেরানো যায়নি। সড়ক আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউই। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে সড়কে ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। তখন অবশ্য শুধুমাত্র ‘ফিডার রোডে’ চলাচলের অনুমতি ছিলো। পরবর্তীতে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এই নিয়ম ভেঙ্গে ভিআইপি রোডেও রিকশা চলাচল শুরু হয়। প্রতিদিন ‘আজব সব মডেলের’ শত শত রিকশা রাস্তায় নামছে। ফিটনেস বিহীন বাস-মিনিবাসে শুধু রাজধানী নয়, দেশের সব সড়ক-মহাসড়ক সয়লাব হয়ে আছে। বাস টার্মিনালগুলোর সামনের সড়কে যে যেভাবে পারছে বাস পার্কিং করে সড়কের বেশিরভাগ অংশ দখল করে রাখছে। ঢাকার সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ি, গুলিস্থান, গাবতলী, মহাখালি, আরামবাগ, পান্থপথ, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার সড়কে দিনরাত লোকাল বাস ও দূরপাল্লার বাসের হযবরল অবস্থা আগের চেয়ে বেড়েছে। ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ব্যাটারি চালিত রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন, করিমনসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে সড়ক নিরাপত্তা অনিশ্চিত করেছে। এদের কাছে হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশও অসহায়।
নগরীর তেজগাঁও এলাকার ৭০ শতাংশ সড়ক অবৈধ দখলে রয়েছে। ফার্মগেট থেকে তোজগাঁও শিল্প এলাকা, গুলশান, রামপুরাসহ পূর্ব দিকে যোগাযোগের ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনের রাস্তাটি পুরোপুরি ট্রাকের দখলে চলে গেছে। এই সড়ক ব্যবহার করে র্ফামগেট থেকে পূর্ব দিকে যাতায়াতে ভোগান্তির শেষ নেই। রাস্তার উভয় পাশে ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখায় রিকশা বা অন্য কোনো যানবাহন চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে। অনেক সময় তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত যেতে আধ ঘন্টার বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক সড়কটি যানজট মুক্ত করতে গেলে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চালক-শ্রমিকরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ-সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনি মুক্ত হন এবং সড়কটি থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ট্রাক টার্মিনালের ভেতরে সরিয়ে নেয়া হয়। গত ৫ আগষ্টের পর সড়কটি আবারো দখল হয়ে যায়।
উল্টোদিকে চলাচল : সড়কের উল্টোদিক থেকে যানবাহন চলাচল বর্তমান সময়ে এক ধরনের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই অটোরিক্সা, মোটরসাইকেল, গাড়ি, বাইসাইকেল উভয় দিক থেকেই চলাচল করছে। এক লাইনের সড়কেও এদিক-ওদিক দু’দিক থেকেই সব ধরনের যানবাহন চলছে ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে। সরকারী-বেসরকারী সব গণপরিবহন রাস্তায় চলাচলে কোনো আইনের তোয়াক্কা করছে না। ভিআইপি সড়কেও এখন প্রায় সব ধরনের যানবাহন উল্টো দিক থেকে চলাচল করতে দেখা যায়। এভাবে যানবাহন চলাচলের কারণে রাস্তায় হযবরল অবস্থা ও দূর্ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে।
বিশৃঙ্খলা বাসস্ট্যান্ডে : রাজধানীর বাস স্টান্ডগুলোতেও নিয়ম ভাঙ্গার দৃশ্য চোখে পড়ছে অহরহ। গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের বিশাল এলাকার সিংহভাগ অংশ খালি পড়ে আছে। অথচ এই টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার বাসগুলোর বেশিরভাগই মূল সড়কের ওপর দীর্ঘ সময় কয়েক লাইনে পার্কিং করে যাত্রী নিচ্ছে। আমিনবাজার সেতুর ওপরও অলিখিত বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। সড়কে দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটের বাস দাড় করিয়ে রাখায় অন্যসব যানবাহন যানজটে আটকা পড়ে থাকছে দীর্ঘ সময় ধরে। বাস টার্মিনালের পরই আমিনবাজার সেতুর আগে ট্রাকের দখলে থাকে মূল সড়ক। এছাড়া গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সড়কের দীর্ঘ এলাকা জুড়ে লোকাল বাস দাঁড়িয়ে থাকার কারণে সড়কে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে মিরপুর মাজার রোড থেকে আমিনবাজার সেতু পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের দৃশ্য এখন প্রতিদিনের।
মহাখালী বাস টার্মিনালের ভেতর দেখা যায় অব্যবহৃত ও ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। অথচ এই টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া সব পরিবহন কোম্পানির বাসগুলোও এখন প্রধান সড়কে পার্কিং করে যাত্রী তুলছে। এখানেও মূল সড়কে বাসগুলো দাঁড়িয়ে থাকায় স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে, দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকার অবস্থা আরো খারাপ। টার্মিনালের ভেতরের জায়গা ফাঁকা থাকলেও মূল সড়কের ওপর দাড়িয়ে থাকা বাসের কারণে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল থমকে যাচ্ছে। সায়দাবাদ রেলক্রসিং পাড় হওয়ার পর থেকে জনপদ মোড় হয়ে উত্তর দিকে ধলপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে সব দূরপাল্লার বাসের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। এই এলাকায় পুলিশের কথা কেউ শোনে না। বাস চালকদের ইচ্ছাই এখানে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া জনপথ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ি মোড় পর্যন্ত সড়কে প্রায় ২৪ ঘন্টাই যানজট লেগে থাকে। জনপথ রোড়ের দুই পাশের বাস কাউন্টারের সামনে থেকে একটি বাস যাত্রাবাড়ি মোড় পর্যন্ত পৌছাতে আধ ঘন্টা লেগে যায়। যাত্রাবাড়ি মোড়ে এক দিকে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা এবং অন্যদিকে সড়কের ওপর যানাবাহনের অবৈধ পাকিংয়ের কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে হাজার হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশার সবমুখী চলাচল। এই মোড়ে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হওয়াও বিপদজনক অবস্থায় পৌছেছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, বর্তমানে সড়কে ব্যাটারি রিকশা সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। এই রিকশার কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে এবং যান্ত্রিক যানবাহনের স্বাভাবিক গতি কমিয়ে দিচ্ছে। ব্যাটারি চালিত রিকশা রাজধানী ঢাকাকে একটি মফস্বল শহরে পরিণত করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেমন বিআরটিএ ও পুলিশ এবং মোবাইল কোর্টও পক্ষপাতদুষ্ট নজরদারি ও চাঁদাবাজিতে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে বিআরটিএ। তারা সড়ক নিরাপদ করার ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে ‘দুর্নীতির আখড়া’ হিসেবে পরিচিত।
তিনি বলেন, গণপরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার পেছনে এক শক্তিশালী পরিবহন সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায় এই সিন্ডিকেট কারো তোয়াক্কা করছে না। এদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। এই অবস্থার উত্তরণ না ঘটলে পরিবহন সেক্টরে যেমন শৃঙ্খলা ফিরবে না, তেমনি সড়ক কখনো নিরাপদ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর দেশের নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থা নির্ভর করছে।
ডাইভারসনে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে : রাজধানীর সড়কে নতুন ট্রাফিক ব্যবস্থায় সংস্কার বেশিরভাগ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান সরকারের আমলে সড়কে ‘পরীক্ষামূলক’ নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এসব নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে কার্যত এক বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ নগরীর অন্তত ৬৯টি পয়েন্টে ট্রাফিক ডাইভারশন চালু করেছে। এই পরিবর্তনের ফলে ব্যস্ততম সড়কগুলোতে নতুন করে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সড়ক ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, ডাইভারশনের ফলে কেউ কেউ সুবিধা পেলেও ভোগান্তিতে পড়া মানুষ ও যানবাহনের সংখ্যাই বেশি। ডাইভারসনের ফলে অনেক সড়কে রিকশা ও সিএনজি বেবিটেক্সির ভাড়া বেড়েছে।
সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মতো যানজটে ভরা শহরে এই ডাইভারশন উপযোগী নয়। ডাইভারসনের কারণে কোথাও কোথাও এখন ১০ মিনিটে পথ পেরিয়ে যেতে দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগছে।
এছাড়া বাংলামোটর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ সাতটি মোড়ে অটোসিগন্যাল থাকলেও যান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। ফলে অটোসিগন্যাল এবং পুলিশের নির্দেশনার দ্বৈততায় এই সড়কের অবস্থারও পরিবর্তন হয়নি। পথচারী ও চালকদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
অসহায় পুলিশ : গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে মাধ্যমে অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই রাজধানীর রাস্তায় চরম ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মনোবল হারানো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেকটাই চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সড়কে সড়ক নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নে তাদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। সরকার বদলের পর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তহীনতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে পুলিশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরব থেকে ডিউটি করছে। পুলিশ আইন প্রয়োগের চেষ্টা করলেই নানান ভয় দেখানো হয়, মব সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এমনকি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন সময় মারধর ও প্রাণ নাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। একারণে পুলিশ আর আগের মতো দায়িত্ব নিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপরতা দেখাচ্ছে না।
ফিটনেস বিহীন বাস-মিনিবাস-পিকআপে সয়লাব সড়ক : ফিটনেস বিহীন বাস-মিনিবাস-পিকআপে সয়লাব হয়ে আছে রাজধানীর সড়ক। গত বছরের ৫ আগষ্টের পর মেয়াদ উত্তীর্ণ এসব যানবাহন ব্যাপকহারে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআরটিএ এবং পুলিশ বিভাগের। ট্রাফিক পুলিশ মাঠপর্যায়ে কার্যত দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের মনোবলে ভাঙ্গন ধরেছে। আমিনবাজার, ডেমরা, যাত্রাবাড়ি, সায়দাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজগুলোতে থাকা মেয়াদ উত্তীর্ণ ও ফিটনেস বিহীন বাস-মিনিবাসগুলো রাস্তায় নেমে পড়েছে। পরিবহন ব্যবসায়ী মালিক সিন্ডিকেটের প্রভাবের কারণে বর্তমান সরকার পর্যন্ত এগুলোকে রাস্তা থেকে সরাতে পারছে না।
