তাহিরপুরে ৬ শতাধিক নৌকায় কোটি কোটি টাকার পণ্য আটকা

মো. সাজ্জাদ হোসেন শাহ্, তাহিরপুর থেকে ফিরে
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪২ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
প্রতি শীত মৌসুমে তীব্র নৌজটের শিকার হয় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার পাটলাই নদী। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত ১০ দিন ধরে নদীটির দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন অংশে আটকা পড়ে আছে প্রায় ৬ শতাধিক কয়লা ও চুনাপাথরবাহী স্টিল বডির বাল্কহেড নৌকা। বাংলা মাঘ মাসের শুরু থেকেই এই নৌজট দেখা দিয়েছে, যা ব্যবসায়ী, নৌযান মালিক, চালক ও শ্রমিকদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে।
এতে তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর এই সময়ে পাটলাই নদীর প্রায় ৬ কিলোমিটারজুড়ে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। তবে নাব্যতা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) গত দুই বছর ধরে নদী খনন কার্যক্রম চালালেও এর কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, তাহিরপুরের তিনটি শুল্ক স্টেশনের আমদানিকৃত কয়লা ও চুনাপাথরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলার পণ্য পরিবহনের একমাত্র নৌপথ এই নদীতে প্রতিবছরই শীত মৌসুমে নাব্যতা সংকটের কারণে ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা দেয় চরম জট। পাটলাই নদীর সুলেমানপুর বাজার থেকে পাটাবুকা গ্রাম হয়ে কানামইয়া জলমহল পর্যন্ত এই সংকট সবচেয়ে তীব্র। যেখানে ৩০ মিনিটের নৌপথ পাড়ি দিতে সাধারণত ১৫-২০ দিন লেগে যায়। প্রতিদিন ১৫-২০টি নৌকা জট থেকে বের হলেও পেছনে যুক্ত হয় নতুন করে ৪০-৫০টি নৌকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী বড়ছড়া, বাগলী ও চাড়াগাঁও তিনটি শুল্কস্টেশন থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার কয়লা-চুনাপাথর এবং ফাজিলপুর বালু মহলের বালু সাভার, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দাউদকান্দি, ভৈরব, টাঙ্গাইল সিরাজগঞ্জ, বাগানবাড়ি, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জসহ সারাদেশের বিভিন্ন ইটভাটায় কয়লা ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে চুনাপাথরের জোগান দেন স্থানীয় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
এছাড়াও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা, কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করা হয় এ নদী দিয়ে। এসব পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম নদীপথ। কিন্তু নদীর নাব্য সংকটের ফলে প্রতি বছরই মাঘ মাসের প্রথম থেকেই পাটলাই নদীতে আটকা পড়ে শত শত মালবাহী নৌযান। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র নৌজট। কোটি কোটি টাকার কয়লা ও চুনাপাথর বোঝাই নৌকাগুলোকে পাটলাই নদীতে নৌজটে আটকা পড়ে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে পাটলাই নদীতে গিয়ে নৌকা মাঝি, কয়লা-চুনাপাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাঘ মাসের প্রথম থেকে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে প্রতি বছর এ নৌজটের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদেরকে। তারা জানিয়েছেন, প্রতি বছর হেমন্তে পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা কমে যায়। এতে আড়াই থেকে তিন মাস নদীতে নৌজট লেগেই থাকে।
কয়লাবাহী বাল্কহেডের মাঝি বিলাল মিয়া বলেন, কয়লা নিতে আসার সময় নদীতে পানি ছিল এবং নৌকা খালি ছিল শুল্ক স্টেশনে ঢুকতে কোনো সমস্যা হয়নি। কয়লা নিয়ে গন্তব্যে ফেরার পথে পানি কমে যাওয়ায় নৌজটে আটকা পড়লাম আজ ৫ দিন হয়ে গেছে। এক জায়গায় আটকা পড়ায় জ্বালানি, নৌশ্রমিকদের মজুরি, ঘাটে বসে খাওয়া-দাওয়া ও পকেট খরচ বাবদ প্রচুর টাকা ব্যয় হচ্ছে। কোনদিন এ জট থেকে বেড় হতে পারব এখনো বুঝতে পারছি না।
বিসমিল্লাহ পরিবহন নৌকার মাঝি মিয়া হোসেন বলেন, নৌজটের কারণে তারা ভয়ে রাত্রিযাপন করেন। নৌজট নিরসনের নামে স্থানীয় একটি মহলকে চাঁদা দিতে হয়। এতে বিপাকে পড়েছেন নৌযান নিয়ে আটকেপড়া মালিক, মাঝি এবং ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবছর এই মৌসুমে নৌজটের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় বলে জানান পণ্যবাহী বাল্কহেডের একাধিক চালকরা। তারা বলেন, আটকে পড়া বাল্কহেডের ওজন কমানোর জন্য মালামাল নামিয়ে ছোট ছোট ভাড়া নৌকায় ওঠানো হয়। পরে কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছোট নৌকা থেকে ফের ওই বাল্কহেডে মালামাল লোড করে দেয়া হয়। বাল্কহেড দিয়ে পণ্য পরিবহন করে যেখানে ব্যবসায়ীদের লাভ হওয়ার কথা সেখানে উল্টো গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের লোকসান। তারা আরো বলেন, কোটি কোটি টাকার মালামাল পরিবহনের একমাত্র নৌপথ এ নদী। সরকার যদি নদীগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে ভালোভাবে খননকাজ করতো, তাহলে হয়তো এ ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলত আমাদের।
আমদানিকারক হাজী মুজিবুর রহমান বলেন, নাব্যতা সংকটের ফলে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে কত দিন সময় লাগবে তা বলা যাচ্ছে না। ক্রেতাদের সময় মতো মালামাল দিতে না পারায় এসময় প্রতি বছর আমাদের আমদানিকারগণকে চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাজী খসরুল আলম বলেন, পাটলাই ও পাইকরতলা নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে প্রতিবছর হেমন্ত মৌসুম এলেই কয়লা ও চুনাপাথর পরিবহনে ব্যবসায়ীদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তারা আরো বলেন, গ্রুপের (বড়ছড়া, চারাগাঁও ও বাগলী) শুল্ক স্টেশন থেকে সরকার প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে থাকে।
তারা ব্যবসায়ীদের সুবিধার দিক বিবেচনা করে পাটলাই ও পাইকরতলা নদীটি জরুরি ভিত্তিতে খনন করার দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, গত ১৫-১৬ বছর ধরে এসময় আমরা ব্যবসায়ীদেরকে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নৌ পুলিশের সঙ্গে আমরা সমিতির পক্ষ থেকেও চেষ্টা করছি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নৌকাগুলো বের করে দেয়ার। নৌজটকে কেন্দ্র করে কোনো দুষ্কৃতকারী যেন কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বানও জানান তিনি।
সুনামগঞ্জের টুকেরবাজার নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন খান বলেন, নৌজট নিরসনে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে। আটকেপড়া নৌযানের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য নৌ পুলিশের একটি টহল দল সেখানে নিয়মিত টহল করছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল হাসেম জানিয়েছেন, নৌজট নিরসনে উপজেলা প্রশাসন ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারব।