প্যাকেটজাত খাবার মানেই নিরাপদ খাবার নয়: যতীন টাক্কার
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ০২:১৬ পিএম

সিগওয়ার্কের ভারত অঞ্চলের ব্র্যান্ড ওনার কোলাবোরেশন বিভাগের হেড যতীন টাক্কার।
শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে মনে করা হয়, প্যাকেটজাত খাবার মানেই নিরাপদ। এটা ঠিক, রাস্তার খোলা খাবার থেকে প্যাকেজিং খাবার অনেক নিরাপদ। তবে আপনি কোন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার বেছে নিচ্ছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একান্ত সাক্ষাৎকারে এমনটা বলছিলেন সিগওয়ার্কের ভারত অঞ্চলের ব্র্যান্ড ওনার কোলাবোরেশন বিভাগের হেড যতীন টাক্কার। স্বাস্থ্যসম্মত প্যাকেট খাবার নিশ্চিত করতে তার প্রতিষ্ঠান খাবার প্যাকেজিংয়ে টলুইনমুক্ত কালি ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়। তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম টলুইনযুক্ত কালি বিক্রি করবো না, ক্ষতিকর কোনো কালিও উৎপাদন করবো না। বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে।
ভোরের কাগজ: নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
যতীন টাক্কার: নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং কী, সেটা আমাদের জানা দরকার। বাংলাদেশের বাজারে প্যাকেটজাত খাবারের চাহিদা অনেকে বেড়েছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি প্যাকেটজাত খাবার কিনছেন। এর প্রধান কারণ, মানুষ মনে করে প্যাকেটজাত খাবার মানে খোলা খাবারের চেয়ে নিরাপদ। প্রাথমিকভাবে প্যাকেজিং খাবারকে সুরক্ষা দেয় সেটা ঠিক, তবে প্যাকেজিং মানেই যে নিরাপদ তা বলা যাবে না। যেমন আমরা যদি নুডুলস প্যাকেজিংয়ের কথা বলি, সেখানে দেখা যায় প্লাস্টিকের ফয়েল পেপার এবং রং ব্যবহার করা হয়। এগুলো রাসায়নিক এবং আপনি যদি ভুল রাসায়নিক নির্বাচন করেন তাহলে সেটি খাবারে মিশে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। দুটি কারণে নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং গুরুত্বপূর্ণ। এর একটি, প্যাকেট খাবারের চাহিদা বেড়েছে। আমরা যেহেতু একটা উন্নয়নশীল অবস্থায় রয়েছি, সেখানে খাবার নিয়ে সম্ভাব্য হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে। ফলে খাবার যদি সব দিক থেকে নিরাপদ না হয়, তাহলে আমাদের সার্বিক খরচ আরও বেড়ে যাবে। অন্যটি হচ্ছে, টেকসই ভবিষ্যৎ। আমরা চাই খাবার প্যাকেজিংকে এমনভাবে কাঠামোবদ্ধ করতে যেখানে নিরাপদ উপাদান থাকবে। কেননা রাসায়নিক দূষণ কমানোর জন্য এর বিকল্প নেই। এই দুটি কারণে নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভোরের কাগজ: বাংলাদেশে নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী এবং এটি কীভাবে সমাধান করা সম্ভব?
যতীন টাক্কার: বাংলাদেশে মূল চ্যালেঞ্জ এখন সচেতনতা তৈরি। আপনি যদি বাংলাদেশের বাজারের কথা বলেন, সাধারণভাবে ভোক্তাদের কথা বলেন, এমনকি সাধারণভাবে ব্র্যান্ডের কথা বলেন তবে দেখা যাবে, খাদ্য প্যাকেজিংয়ের হুমকি সম্পর্কে এখানে কারও কাছেই পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তাই, এটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একবার সচেতনতা তৈরি সম্ভব হলে ব্র্যান্ডগুলো এসব হুমকি সম্পর্কে আরও সচেতন হবে, তারা বুঝবে সম্ভাব্য ক্ষতির জন্য তারা দায়ী। বাংলাদেশে ব্র্যান্ডগুলো ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরাপদ খাবার পৌঁছে দিতে চায়। তবে প্রক্রিয়াটি অনেকের নজর এড়িয়ে যায়। সিগওয়ার্ক নিরাপদ খাবার প্যাকেজিংয়ে নিরাপদ কালির ব্যবহার নিয়ে গত চার-পাঁচ বছর থেকে বাংলাদেশে সচেতনতা তৈরির কাজ করছে। গত বছর আমরা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, স্বনামধন্য কিছু ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছি। যার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাপ্লাই চেইনে সচেতনতা তৈরি করেই আসলে এই খাতের সব স্টেকহোল্ডারদের একত্রে আনা সম্ভব হচ্ছে। এখন তারা বলছে, এই হুমকি মোকাবিলা করতে হবে।
ভোরের কাগজ: গত বছর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই নিরাপদ খাবার প্যাকেজিং নিয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে, তারা একটি মান প্রণয়ন করেছে। এতে বাংলাদেশে এই খাতের সম্ভাবনা কতটা বেড়েছে বলে মনে করেন?
যতীন টাক্কার: বাংলাদেশ একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির বাজার। এটি যেমন স্থানীয় বাজার, তেমনি আবার রপ্তানিরও। যখন আপনি কোনো পণ্য রপ্তানি করতে যাবেন সেটির মান অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানে হতে হয়। সেখানে রেগুলেটরের ভূমিকা অনেক। কারণ, রপ্তানি পণ্য অবশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে না এটা নিশ্চিত করতে হয়। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। গতবছর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই খাবার প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে নিরাপদ কালির ব্যবহার নিয়ে একটি মান প্রণয়ন করেছে। এই শিল্পের জন্য এটি একটি গাইডলাইন, যে কীভাবে প্যাকেজিংয়ের কালি ব্যবহার করা যাবে। প্রতিটি কোম্পানির আলাদা স্ট্যান্ডার্ড থাকলেও এখন থেকে বিএসটিআই-এর মান অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তার কাজ করেছে। এখন এই মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের। সেই সঙ্গে আমাদের মতো ব্র্যান্ডের এগিয়ে আসতে হবে এটা নিশ্চিত করতে এবং সচেতনতা তৈরি করতে।
ভোরের কাগজ: বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য প্যাকেজিং উন্নত করতে সিগওয়ার্ক কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
যতীন টাক্কার: সাধারণ মানুষকে নিরাপদ খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বিএসটিআই পণ্য প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত কালির মান নির্ধারণ করেছে। অবশ্য আমরা তার অনেক আগে থেকে এটি নিয়ে কাজ করছি। যখন আমরা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করি, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাবার প্যাকেজিংয়ে টলুইনমুক্ত কালি ব্যবহার। প্রথম দিন থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম টলুইনযুক্ত কালি বিক্রি করবো না, ক্ষতিকর কোনো কালিও উৎপাদন করবো না।খাবার প্যাকেজিংয়ে টলুইনমুক্ত কালি ব্যবহার। প্রথম দিন থেকেই আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম টলুইনযুক্ত কালি বিক্রি করবো না, ক্ষতিকর কোনো কালিও উৎপাদন করবো না। আমরা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তায় নীতিমালার আগে থেকেই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি। বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে আমরা একটুকু জানি, মানব শরীরের জন্য রাসায়নিক পদার্থ অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা বাংলাদেশের বাজারে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই, যাতে অন্যান্য দেশ তাদেরকে অনুসরণ করে। ঠিক একই কারণে আমরা বাজার থেকে টলুইন, খনিজ পদার্থ এবং বেনজোফেনোনের মতো রাসায়নিক পদার্থগুলো নির্মূল করেছি। যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালায় বলা নেই, যে আমরা এখন কী করবো, সেজন্য আমরা নিজ থেকেই ইউপিআই পলিসি করার পদক্ষেপ নিয়েছি। সে নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য কালি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে আর্সেনোজেনিক, মেটা-জিওনিক এবং রিপ্রোটক্সিকের মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থগুলো ব্যবহার থেকে বিরত রাখা। আমরা সক্রিয়ভাবেই এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি।
ভোরের কাগজ: আপনারা কোন দেশ থেকে এই রাসায়নিক পদার্থ আমদানি করেন?
যতীন টাক্কার: এটি মূলত কাঁচামালের পছন্দের ওপর নির্ভর করে। আমরা বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করি।
ভোরের কাগজ: সিগওয়ার্ক কীভাবে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী তার খাদ্য প্যাকেজিং সল্যুশনসের স্থায়িত্ব ধরে রেখেছে?
যতীন টাক্কার: স্থায়িত্বের কথা বলতে গেলে আমাদের এখন দুটি প্রধান পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের প্রথমে স্টেক হোল্ডারদের একত্র করতে হবে। অক্সিজেন এবং পানিতে বাধা দেয়, এমন কিছুই কোটিংও আমাদের উন্নত করতে হবে। আপনি যদি মাল্টিলেয়ার প্লাস্টিক থেকে মোনোলেয়ার প্লাস্টিকের দিকে যান, আপনি কিন্তু কাঠামোও পরিবর্তন করছেন। সেজন্য আমরা কোটিংগুলোকে এমনভাবে উন্নত করছি, যাতে ট্রানজেকশন মসৃণ হয়। আপনি সহজেই একটি থেকে অন্যটিতে ট্রানজিট করতে পারেন।
ভোরের কাগজ: কোন কেমিকেলগুলো খাবার প্যাকেজিং ও কোটিংয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে?
যতীন টাক্কার: প্যাকেজিংয়ে যেসব কালি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের সংমিশ্রণ। যদি কোনো কালি শুধু এক রঙের হয়, সেখানেও ১৫ ধরনের রাসায়নিক থাকে। যেগুলোর বেশিরভাগই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিছু বিষাক্ত পদার্থ যেমন- টলুইন, মিনারেল ওয়েল, বেজাফেনোন– এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব পদার্থ প্রোডাক্টের ধারাবাহিকতার ওপর প্রভাব ফেলে এবং খাবারের সঙ্গে মিশে গুণগত মান নষ্ট করে। পাশাপাশি এসব কেমিক্যাল ভোক্তার স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে ক্যানসার আক্রান্ত, কানে কম শোনা, হেলুসিনেশনের মতো সমস্যা হতে পারে; যা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।
ভোরের কাগজ: বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য প্যাকেজিং সম্পর্কে সবচেয়ে সাধারণ ভুল ধারণা কী এবং সিগওয়ার্ক কীভাবে সেগুলো সমাধান করে?
যতীন টাক্কার: শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে মনে করা হয়, প্যাকেটজাত খাবার মানেই নিরাপদ। এটা ঠিক, রাস্তার খোলা খাবার থেকে প্যাকেজিং খাবার অনেক নিরাপদ। তবে আপনি কোন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার বেছে নিচ্ছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে কোন কোন উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি কতটুকু নিরাপদ, সেটি সবার আগে জানতে হবে। সিগওয়ার্ক এই নিরাপদ খাদ্য প্যাকেজিং নিয়েই কাজ করছে এবং সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমরা বিভিন্ন কোম্পানি, স্টেকহোল্ডার, সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ উপস্থাপন করছি, ব্র্যান্ডের মালিক, মিডিয়া এবং নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেছি।
ভোরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভোক্তা নিরাপত্তার বৈশ্বিক ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্যাকেজিং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম?
যতীন টাক্কার: বাংলাদেশ সঠিক পথেই হাঁটছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আপনাকে উন্নয়নের জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। সে জন্য একটি কঠোর নীতিমালাও করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেকাংশে প্যাকেজ খাবারের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে আপনাকে প্যাকেজিং উপাদানের উপর অনেকটা নির্ভর করতে হবে। আপনাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, খাবার প্যাকেজিংয়ের ক্ষতিকর উপকরণ যাতে ব্যবহার না করা হয়। এজন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো শনাক্ত করতে হবে এবং নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যা বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই করেছে। প্যাকেজ খাবার ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ কি না, সেটি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ। আর আমি মনে করি, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে এই চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে গ্রহণ করেছে এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।