বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাড়বে সংকট, শঙ্কা আন্তর্জাতিক সংস্থার

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১২:১৫ পিএম

এক কঠিন মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতি।ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক কঠিন মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা, মূল্যস্ফীতির চাপ এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা—সব মিলিয়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরটি আরো সংকটপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংক।
বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৫ শতাংশের নিচে নামতে পারে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৮ শতাংশ, যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ৩.৯৭ শতাংশের হিসাব থেকেও কম।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও তা ৫.৪ শতাংশে আটকে থাকবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া উত্তরণ কঠিন
ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড সভায় সোমবার (২৩ জুন) বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৮০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেয় সংস্থাটি। তবে এ অর্থায়নের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া পূর্বাভাসে উঠে আসে কঠোর সতর্ক বার্তা।
আইএমএফ বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, যা পূর্বাভাসের ৬ দশমিক ৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। সংস্থাটি উল্লেখ করে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কঠোর মুদ্রানীতি ও ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাইজেল ক্লার্ক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুস্তরীয় চাপে রয়েছে। কাঠামোগত সংস্কার, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’
রাজস্ব ঘাটতি ও ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৬ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। মে মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৮৩ দশমিক ১০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে জুন মাসেই আদায় করতে হবে আরো ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা—যা ‘প্রায় অসম্ভব’ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আরো পড়ুন : আইএমএফের ১৩০ কোটি ডলার পেলো বাংলাদেশ, রিজার্ভ ছাড়াল ২৭ বিলিয়ন
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংক খাতের নাজুক অবস্থা। বর্তমানে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বছরের শেষ নাগাদ এটি ৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো, ফলে নতুন বিনিয়োগে ঋণ দেওয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
সরকারি ঋণ নির্ভরতা ও সুদের চাপে বেসরকারি খাত
সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ১ দশমিক ০৪ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়। এতে তারল্য সংকট আরো তীব্র হওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের জন্য ঋণের সুযোগ সংকুচিত হবে। বাড়বে সুদের হারও, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করবে।
মূল্যস্ফীতির চাপ ও বৈদেশিক সংকট
চলতি অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ভোক্তা পর্যায়ে চাপ অব্যাহত রাখবে। আগামী অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নামার পূর্বাভাস দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি, হরমুজ প্রণালির সংকট এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি পরিবহন ব্যাহত হয়, তাহলে জ্বালানি আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এতে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স, আমদানি-রফতানি ও শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে জটিলতা তৈরি হলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারাতে পারেন। তেল-গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে দেশের শিল্প খাতও নতুন সংকটে পড়বে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি লক্ষ্য সাড়ে ৬ শতাংশ হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও নিচের মাত্রায় নামিয়ে আনতে চায়।
বিনিয়োগ-রফতানিতে ভাটা, কর্মসংস্থানে প্রভাব
দেশে ও বিদেশে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাময়িকভাবে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা চলছে, তবে এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ডলার সংকট শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত করছে। এতে ঋণখেলাপির আশঙ্কা বাড়ছে।’