স্ট্রোক হলে চিকিৎসার বিলম্বে বেড়ে যায় মৃত্যু-পঙ্গুত্বের ঝুঁকি
সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:২২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
‘স্ট্রোক’- এই রোগের নাম জানে না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের একটি রক্তনালির রোগ বা মস্তিষ্কের অসুখ। ঘাতক এই ব্যাধিতে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত হন, যার মধ্যে অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ মারা যান। আরো অর্ধকোটি মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেন। আর দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যার অর্ধেকেরও বেশি সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় মারা যান বা স্থায়ী অক্ষমতায় ভোগেন।
এদিকে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সীদের মধ্যেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং তাদের ঝুঁকিও বাড়ছে। সুইডিশ কিছু গবেষণায় পেশেন্ট রেজিস্ট্রি আছে, ফিনল্যান্ডে রেজিস্ট্রি আছে। সবগুলো জায়গায় তারা দেখছেন, কম বয়সীরা; এক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৪৫ এর কম, এদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যাচ্ছে।
চিকিৎসকরা এ-ও বলছেন, অধিকাংশ মানুষই স্ট্রোককে হার্ট অ্যাটাক মনে করেন। ফলে চিকিৎসা পেতে দেরি হয়। আর এতে মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব- উভয় ঝুঁকিই বাড়ে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, হার্ট অ্যাটাক বলতে হৃৎপিণ্ডের ধমনীর রক্তপ্রবাহে বিভিন্ন কারণে অবরোধের ফলে হৃৎপিণ্ডের পেশিকলার মৃত্যুকে বোঝায়।
চিকিৎসকরা জানান, অধিকাংশ মানুষ স্ট্রোককে হার্ট অ্যাটাক মনে করে রোগীকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে শনাক্তের পর নিউরো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়। আবার জ্যাম ঠেলে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা পেতেও দেরি হয়। এতে চিকিৎসা শুরু হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও অনেক ক্ষেত্রে বাঁচানো সম্ভব হয় না; অথচ স্ট্রোকের চিকিৎসা সময়মতো না নিলে পঙ্গুত্ব ও হৃদরোগসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়।
দিনদিন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়লেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোকের সুচিকিৎসা ব্যবস্থা আছে শুধু রাজধানী ঢাকায়। ঢাকার বাইরে থেকে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে আসতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। অথচ স্ট্রোকের পর প্রথম চার ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে আনা গেলে এবং এলটিফেস নামক একটি ইনজেকশন নিতে পারলে রোগী দ্রত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এসব রোগীর চিকিৎসায় সময়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্রোকে আক্রান্তদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ, ৩০ শতাংশের রক্তে কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস। ‘ল্যানসেট জার্নাল’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মাত্র ১০টি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব। গবেষকদের মতে, এই ১০টি কারণ হলো- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, স্থূলতা, ধূমপান, মদ্যপান, হার্টের রোগ, শারীরিক পরিশ্রম না করা, মানসিক অবসাদ এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মানা। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত কারণের মধ্যে রয়েছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ে। পুরুষদের বেশি ঝুঁকি এবং বংশে নিকটাত্মীয়দের স্ট্রোকের ইতিহাস থাকা, রক্তনালিতে ফোসকা বা এনিউরিজম অথবা রক্তনালির অস্বাভাবিক কমিউনিকেশন বা এভিএম-এর মতো রক্তনালির সমস্যার জন্যও স্ট্রোক হতে পারে।
নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের স্ট্রোক ও ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগের চিকিৎসক হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, অনেকে স্ট্রোক করলে এটিকে হার্টের অসুখ মনে করে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ছুটে যান, যা মোটেও ঠিক নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ, হৃদরোগ নয়। হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের উপসর্গে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- বুকে তীব্র ব্যথা, মনে হয় বুকে পাথর চেপে বসে আছে। এই ব্যথা হাতে বা গলায় যেতে পারে, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বমি বমি লাগা বা বমি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। আর স্ট্রোকের উপসর্গের মধ্যে রয়েছেÑ শরীরের কোনো এক পাশ অবশ হয়ে যাওয়া বা ঝিমঝিম করা, মুখ বেঁকে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা বা একটি জিনিস দুটি দেখা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক আচরণ করা এবং ভারসাম্যহীনতা। স্ট্রোকে তীব্র মাথাব্যথা হতে পারে, ঠিক যেমন হার্ট অ্যাটাকে বুকে ব্যথা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর দিবসটি পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নানা কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে।
