পশ্চিমা নেতাদের মুখ রক্ষায় কী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৫১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল। গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত রবিবার দেশগুলো এ স্বীকৃতি দিয়েছে। শিগগিরই ফ্রান্স স্বীকৃতি দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। ইসরায়েল সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আগ্রাসি অবস্থান আরো জোরদার করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর এক মুখপাত্র বলেন, এই স্বীকৃতি ‘হাস্যকর’। এটি ‘সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করবে’ বলে উল্লেখ করেছেন নেতানিয়াহু। গত ১৫ সেপ্টেম্বর অধিকৃত পশ্চিম তীরে এক অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহু তার সমর্থকদের উদ্দেশে দম্ভভরে বলেন, ‘ফিলিস্তিন নামে কোনো রাষ্ট্র হবে না।’
কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের এই স্বীকৃতি সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক খবরের প্রধান শিরোনাম। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, অবমাননা, হত্যাকাণ্ড ও শত-সহস্র ফিলিস্তিনিকে ঘরছাড়া করার বিরুদ্ধে এটি একটি ক্ষুদ্র ও প্রতীকী পদক্ষেপ। তবে এর বাইরেও পদক্ষেপটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক রয়েছে।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবু রাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা কেবল একটি সমঝোতাপূর্ণ চুক্তির পরই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু এর আগেই প্রচলিত ধারা ভেঙেই দেশগুলো স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। এ কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ইসরায়েল আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আমি মনে করি, এটি তাৎপর্যপূর্ণ।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে চার দেশের স্বীকৃতি দেয়ার দিনও গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় অন্তত ৫৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৩৭ জনই গাজা নগরীর।
লোকদেখানো স্বীকৃতি
ইসরায়েলি আগ্রাসনের ফলে চরম দুর্দশায় জীবন কাটছে ফিলিস্তিনিদের। এই স্বীকৃতি কি তাদের দুর্দশার অবসান ঘটাবে? কোনো বাস্তবসম্মত পরিবর্তন কি আসবে? সংশয়ে আছেন বিশ্লেষকেরা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৫ হাজার ২৮৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। যুদ্ধে আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৫ জন। তবে অনেক বিশ্লেষকের বিশ্বাস, হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং বসতি স্থাপনকারীদের সহিংস হামলায় এখন পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সরকার হুমকি দিয়েছে, তারা পুরো অঞ্চলটি নিজেদের দেশের সঙ্গে যুক্ত করে নেবে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে চার দেশের স্বীকৃতি গাজায় যুদ্ধ থামাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এ যুদ্ধকে ইসরায়েলি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো জাতিগত হত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
স্বাধীন গবেষক ক্রিস ওসিক বলেন, এই স্বীকৃতির পাশাপাশি যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র অবরোধ এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনে নো ফ্লাই জোন বাস্তবায়নের মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আশাবাদী হতে পারছি না।
দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক মোহাম্মদ এলমাসরি বলেন, এটি মূলত লোকদেখানো স্বীকৃতি। আমি মনে করি, তারা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। যাতে বলতে পারে যে, তারা কিছু একটা করেছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
তবে এরপরও এই স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ফিলিস্তিন সরকার স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি ও রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করতে পারবে। এরইমধ্যে যুক্তরাজ্য ঘোষণা করেছে, তারা হুসাম জোমলটকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।
আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগদান
বিশ্বের বড় একটি অংশ এরইমধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি আরো কিছু স্বীকৃতি যোগ হয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র, হাতেগোনা কিছু ইউরোপীয় ও বাল্টিক দেশ, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ কয়েকটি দেশ এখনো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়নি।
বেশিরভাগ দেশের স্বীকৃতি পেলেও জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হতে পারেনি ফিলিস্তিন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবু রাস বলেন, মার্কিন সহায়তা ছাড়া এসব স্বীকৃতি জাতিসংঘের নতুন কোনো সুযোগ-সুবিধা এনে দেবে না। নতুন করে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যও হতে পারবে না ফিলিস্তিন।
আল রাস বলেন, ‘ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য নয়, বরং পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র।’ পূর্ণ সদস্য হতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ পেতে হবে এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভোট পেতে হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেয়ার ক্ষমতার কারণে এটি প্রায় অসম্ভব।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করতে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে চাপ জোরালো হচ্ছে। গতিশীল হচ্ছে ইসরায়েলকে বর্জনের প্রচার-প্রচারণাও। ফলে ইউরোভিশন ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো থেকে ইসরায়েলকে বাদ দেয়া হতে পারে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সম্প্রতি কিছু ইসরায়েলি পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং দেশটির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়েও আলোচনা করেছে।
মুখ বাঁচাতে স্বীকৃতি
বিশ্লেষকরা বলেছেন, কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করলেও কিছু পশ্চিমা দেশ মূলত গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় এ পদক্ষেপ নিয়েছে। শর্তসাপেক্ষে কিছু দেশের সমর্থনও এ পদক্ষেপের পেছনে জোরালো ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষকরা আরো বলেন, একদিকে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলোর চাপ, অন্যদিকে জাতিগত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জনগণের ক্রমবর্ধমান দাবি, দেশের ভেতরে এমন নানামুখী চাপের কারণেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা।
আল রাস বলেন, বর্তমানে উদার-বামপন্থী সরকারগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে এমনটি ঘটেছে। আসলে কিছুই বদলায়নি। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণকে খুশি রাখতে এটি ছিল অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। তারা আসলে নিজেদের মুখ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরায়েল কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে তিনি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন।
গত রবিবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াও শর্তসাপেক্ষে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পূরণে আরো অগ্রগতি করলে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং দূতাবাস চালুর মতো পদক্ষেপও নেয়া হবে।
এর আগে কানাডা থেকে আসা প্রথম ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি। এক্সে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, কানাডা আজ থেকে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গঠনে অংশীদারত্বের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার পর পর্তুগালের স্বীকৃতির খবর আসে।
জাতিসংঘে পর্তুগালের স্থায়ী মিশনের সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো র্যাঞ্জেল বলেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া পর্তুগালের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক, স্থায়ী ও মূল ভিত্তির বাস্তবায়ন। ন্যায়সংগত ও স্থায়ী শান্তির একমাত্র পথ হিসেবে পর্তুগাল দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে... এখন যুদ্ধবিরতি জরুরি।
ইসরায়েল এই স্বীকৃতির সমালোচনা করে বলেছে, এটি জিহাদি গোষ্ঠী হামাসের জন্য পুরস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদিকে, হামাস নেতারা বলেছেন, ফিলিস্তিকে রাষ্ট্র হিসেবে এই স্বীকৃতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরায়েলে ঢুকে হামাস যোদ্ধাদের হামলার ঘটনারই প্রত্যক্ষ ফল।
সূত্র : আল-জাজিরা