×

জাতীয়

আইনের তোয়াক্কা নেই চালকদের

সড়ক নিরাপত্তায় বিষফোঁড়া: দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ৬ লাখ

Icon

দেব দুলাল মিত্র

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৩০ পিএম

সড়ক নিরাপত্তায় বিষফোঁড়া: দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ৬ লাখ

ছবি: সংগৃহীত

ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনে ভেঙে পড়েছে সড়ক নিরাপত্তা। কালো ধোঁয়া ছেড়ে লক্কড়ঝক্কড়, রংচটা বাসগুলো সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজপথ। নিদিষ্ট স্টপেজ ছাড়াই থেমে থেমে যাত্রী ওঠানাম করানো হচ্ছে। গত এক বছরে রাজধানীসহ দেশের সব সড়কে ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। গত ১ জুলাই থেকে সরকারের পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেনি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোট অথরিটি (বিআরটিএ)। দেশের প্রচলিত আইনে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তবে সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নতুন দাবি, ‘বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ৩০ বছরে উন্নীত’ করা হলে সহজেই মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন সড়ক থেকে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। 

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৬২ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে। এছাড়া যাত্রীবাহী বাস ২০ হাজার ৮৬৮টি, মিনিবাস ১১ হাজার ১৮৫টি, ট্রাক রয়েছে ৫৭ হাজার ৪১টি, প্রাইভেট কারের সংখ্যা ৭৩ হাজার ৭টি, মাইক্রোবাসের সংখ্যা  ৩০ হাজার ৫৩৮টি। পিকআপ ভ্যান রয়েছে ৭২ হাজার ১৫৯টি, ট্রাক্টর রয়েছে ৩৯ হাজার ৫৯১টি, হিউম্যান হলার ১৪ হাজার ৩৮০টি, অ্যাম্বুলেন্স ৩ হাজার ৮১১টি। বিআরটিএর হিসাবে ২ লাখ ৫ হাজার ৬৪৭টি অটোরিকশার ফিটনেস বা হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি এই হিসাবের বাইরে বেশিসংখ্যক যানবাহন দেশের সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিআরটিএর তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১২ মার্চ পর্যন্ত দেশে আনফিট গাড়ির সংখ্যা ৬ লাখ ১১ হাজার ১৪১টি। এর মধ্যে কিছু গাড়ি এখন আর রাস্তায় চলছে না।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম এ প্রসঙ্গে জানান, ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে সমিতির পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে এক-তৃতীয়াংশ এ ধরনের যানবাহন আমরা রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছি। যেসব গাড়ি এখনো সড়কে চলছে সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। 

তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ৩০ বছরে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছি। মালিকদের বিনিয়োগের বিষয়টিও দেখতে হবে। ফিটনেস থাকলে একটি গাড়ি ৩০ বছর পর্যন্ত চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না। ফিটনেস দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। সড়ক বিধি অনুযায়ী গাড়ি চালাতে চালকদের নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। দুই-একজন চালক হয়তো নিয়ম ভঙ্গ করে, সেজন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই হয়।   

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ফিটনেসবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও এই বিষয়টির বাস্তবায়ন আমরা কখনোই দেখতে পাইনি। এর কারণ হচ্ছে স্টেকহোল্ডারদের পাশাপাশি সরকারী যেসব সংস্থা এই কাজগুলো করবে তাদের দায়িত্বহীন আচরণ। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখনো যদি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে আমাদের সড়কে নামার পর স্থবির অবস্থায় পড়তে হবে। একটি দেশের সুন্দর ও পরিকল্পিত যোগাযোগব্যবস্থাই সেই দেশের উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে কেউ ভাবছে বলে সড়কের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় না।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা, যানজট ও বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ হচ্ছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করা। এ ধরনের যানবাহনকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত নয়। আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার বছরজুড়ে। দেশে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো খুবই জরুরি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এটা মানছেন না। আবার সরকারের পক্ষ থেকেই মালিকদের সহায়তা করা হয় না। একটি মেয়াদোত্তীর্ণ বাস উচ্ছেদ করতে চাইলে অপর একটি বাস নামাতে হবে। তা না হলে বাস সংকট দেখা দেবে। কিন্তু নতুন বাস নামাতে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয় না। ফলে লোকসানের ভয়ে মালিকরা মেয়াদোত্তীর্ণ বাস চালানো অব্যাহত রাখেন। বিভিন্ন সময় সরকার সহজ কিস্তিতে ব্যাংক লোনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতার কথা বললেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন বাস দিয়ে নগর পরিবহনব্যবস্থা চালুর কথা বলা হলেও সেখানেও চরম অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। 

এদিকে, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কথা মুখে বললেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর আরো সংশোধন দাবি করছেন তারা। বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ ৩০ বছরে উন্নীত করাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ৮ দফা দাবিও জানিয়েছেন মালিক-শ্রমিকরা। এই দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে আগামী ১২ আগস্ট থেকে সারাদেশে ৭২ ঘণ্টা পরিবহন ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছিলেন। তবে গতকাল রবিবার এই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, দাবি বাস্তবায়নে সরকার দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ একতরফাভাবে শ্রমিক ও মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশেষ করে আইনের ৯৮ ও ১০৫ ধারাসহ কিছু ধারা শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত অন্যায্য ও শাস্তিমূলক। এসব ধারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংশোধন করতে হবে। তারা পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে চালানো অভিযান স্থগিতেরও দাবি জানান।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএ ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ দায় এড়িয়ে যাচ্ছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ রয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে রাজধানীতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা হয়নি। বিআরটিএর কর্মকর্তরা বলছেন, তারা অভিযান চালানো-সংক্রান্ত  বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাননি। 

যাত্রী রায়হান হোসেন বলেন, আমাদের সড়কের বাস্তবতা হলো, সরকারি আইন মানা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে সিদ্ধান্তের ঘোষণা তোয়াক্কা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা করছে না। বারবার সেবার মান বাড়ানোর কথা বলা হয়। কিন্তু সেদিকেও কোনো পরিবর্তন আসছে না। সব বাসেরই রংচটা, জানালা ভাঙা, চালকরা বেপরোয়া, ফ্যানগুলোও নষ্ট থাকে। ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে। বেপরোয়া আচরণের কারণে দুর্ঘটনাও আগের চেয়ে বেড়েছে। যাত্রীর বিমা নেই। সব রুটের বাসেরই একই অবস্থা। দুর্দশা নিয়েই যাত্রীদের পথ চলতে হচ্ছে। 

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, ফিটনেসের দিকে আরো মনোযোগী হওয়ার জন্য বিআরটিএর সক্ষমতা আরো বাড়ানো জরুরি। কিন্তু সরকার সেটা করছে না। সড়কে আইন না মানলে পুলিশকে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু সবাই দায় এড়িয়ে চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এনসিপি নেতাদের বৈঠক, যেসব আলোচনা হলো

যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এনসিপি নেতাদের বৈঠক, যেসব আলোচনা হলো

গুড়ের শরবত কেন খাবেন?

গুড়ের শরবত কেন খাবেন?

'আমরা দীর্ঘদিন ধরেই একসঙ্গে আছি', প্রেমের কথা স্বীকার করলেন জয়া

'আমরা দীর্ঘদিন ধরেই একসঙ্গে আছি', প্রেমের কথা স্বীকার করলেন জয়া

৭ মাসে 'মব সন্ত্রাসে' নিহত ১১১: আসক

৭ মাসে 'মব সন্ত্রাসে' নিহত ১১১: আসক

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App